বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জাতি নির্মাণে গল্পযোগ

 জাতি নির্মাণে গল্পযোগ

 

 মানুষ সামাজিক জীব।তারা পরিবার গঠন করে।তারপর সে-ই পরিবার একটি গোষ্ঠীতে রুপান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে একাধিক গোষ্ঠী একটা জাতিতে পরিনত হয়।অবশেষে তারা তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করে।একাধিক পরিবার ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে যে একটা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়,তার জন্য গল্পের প্রয়োজন হয়।

আমাদের মূখ্য আলোচক মনে করেন, একটা জাতির আত্মসত্ত্বা নির্মাণের পেছনে গল্প থাকে ; যে গল্প সে-ই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং যার ফলে তারা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটা রাষ্ট্র কায়েম করে।গল্পের জন্য প্রয়োজন জাতির ভাষা; যা একাধিক গোষ্ঠীর একীভূত হওয়ার অন্যতম উপযোগ। সামাজক আচার,ধর্মীয় জীবন, বিশ্বাস তাদেরকে এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দেয়।

বাঙালি জাতি- একটা  জাতি হিসেবে পরিচয় পেতে বহুকাল পেরুতে হয়েছে।এ-র প্রধান কারণ ছিলো একটা বিধিবদ্ধ ভাষার অভাব।বর্তমানের বাংলা সুলতানি আমলের শুরুতেও ছিলো বহু আঞ্চলিক ভাষার সমষ্টিমাত্র; যা এলাকা বেধে ভিন্ন ভিন্ন রুপে ব্যবহৃত হতো।বৃটিশ শাসন তাদের স্বরুপে হাজির হওয়ার আগেও বাংলা জনমানুষের ভাষা হতে পারেনি।তাই,বাঙালিরা একক জাতীয় চরিত্রের রুপ পেতে ব্যর্থ হয়েছিলো। এবং এ-ই কারণে জাতি  নির্মাণে  বাঙালির গল্প সৃজনের সুযোগ হয়নি।

২।গল্প একই সাথে  হবে মিথিকাল ও ইথিকাল

 একটা জনসমাজের ঐক্যবদ্ধ চরিত্র সৃষ্টির জন্য সত্য কাহিনী থাকা অত্যাবশ্যক নয়; শুধুমাত্র কাহিনীসূত্রই আবশ্যক।সৃষ্ট ঘটনার উপর ভিত্তি করে গল্প রচিত হবে।গল্পের চরিত্রগুলো মিথিকাল বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হবে; একইসাথে সেগুলো হবে এথিকাল বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ।সেখানে ধর্মের চেয়ে ব্যক্তির কর্মকে বিশিষ্টতা দান করা হবে।একটা জাতির গল্প শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে তাদের এক অখণ্ড পরিচয়।

বৃটিশ শাসনের বদৌলতে কোলকাতা কেন্দ্রিক এক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো ; যারা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তাদের শব্দসম্ভারে ফুটিয়ে তুলিছিলেন।কিন্তু তাদের মধ্যে দু'একজন ব্যাতিক্রম ছাড়া কেউ তাদের সৃষ্টিতে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি।ফলে একক জাতি হিসেবে বাঙালিকে কেউ দেখেছে হিন্দু, কেউ দেখেছে মুসলমান হিসেবে।জাতি হিসেবে ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠবার জন্য যে ঔদার্য ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন ছিলো, তা তাদের লেখায় ফুটে ওঠেনি।ফলে জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি গঠনের গল্পও রচিত হয়নি।

।জাতির ভিত্তি ধর্ম হবে, নাকি ভাষা হবে তা আগেই ঠিক করে নিতে হবে এবং  তার উপর  ভিত্তি করেই গল্পের প্লট নির্মিত হতে হবে।এখানে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিদ্যমান সাংস্কৃতিক চর্চাকে সম্মানজনক মিথষ্ক্রিয়ার  মাধ্যমে  ঐক্যবদ্ধ চেতনায় আনতে হবে।এজন্য জাতির গল্প রচনার জন্য লক্ষ্য সম্পর্কে পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  

সচেতন রাজনৈতিক গোষ্ঠী গল্পের প্লটের নির্দেশকের ভূমিকায় থাকবেন।লেখক,বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন; এটা প্রত্যাশিত।যদি তারা দূরদর্শীতা দেখাতে ব্যর্থ হন,তাহলে বুদ্ধিজীবীদেরকেই জাতির মননের আন্তঃপ্রবাহের মাঝি হতে হবে।কিন্তু বাংলাতে অধিকাংশ লেখক- বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক প্রবাহে ভেসে গিয়েছেন।পরিবর্তন বা নতুন সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় তারা ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

।ভারতবর্ষ ভাগের অনিবার্য কারণ হলো, অখণ্ড জাতি গঠনের জন্য রচিত গল্পের অভাব।দু'শ বছরের পরাধীনতার শৃংখল ভাংগার জন্য দল মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু এতোদিনেও তাদের মধ্যে  ঐক্যের বোধ রচিত হয়নি।কারণ, তাদের  গল্পের প্লট জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে।এ-র জন্য দায়ী একই সাথে ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী। নেতাজী সুভাষ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ব্যতীত কেউ জোরালোভাবে অখণ্ড ভারতের পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি।যদিও বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদগণ যুক্ত বাংলার স্বপ্ন লালন করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।কারণ, ণ্ডিত বাংলার পক্ষে হিন্দু রাজনৈতিক একজোট হয়েছিলেন। এজন্য বলা যায়,বৃটিশ শাসনামলে বাংলায় জন্ম নেয়া গল্প ছিলো ছিলো একটি একক জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি গঠনের অন্তরায় এবং অবশেষে তা-ই সত্য হয়েছিলো।    

।ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে একটা জাতি গঠিত হতে পারে।কিন্তু এ-র উপর ভিত্তি করে জাতি গঠনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ধর্মগুরুরা।তারা  একই ভাষাভাষী ,বর্ণ,সংস্কৃতিক বৈশিষ্টের জনসমষ্ঠির মধ্যেও বিভিন্নভাবে ভয়ানক পার্থক্য আবিষ্কার করে এবং ধর্মের ভয় দেখিয়ে পরষ্পর থেকে আলাদা করে রাখে।ফলে সম্ভাব্য ঐক্যবদ্ধ একটা জাতি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়।এক্ষেত্রে সূফীসাধকগণ স্পষ্টতঃ উদার।

।গল্প গালের জোরে রচিত হয়না; তা মানুষই রচনা করে এবং মানষই লালন করে।যারা মানুষকে ভাগ করা আর ভোগ করার গল্প রচনা করে তাদেরকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা উচিত।গল্পের উপাদান হিসেবে তাদেরকে উপেক্ষা করা উচিত।এদেরকে ফসলি জমিতে আগাছার মতো বিবেচনা করা সঙ্গত ।

।।জাতি নির্মাণের গল্পের ভিত্তি মজবুত হলে সে-ই জাতি একটি রাষ্ট্র নির্মাণে ব্রতী হয় এবং সে-ই রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত হয়।জাতি নির্মাণের গল্পে থাকবে উদারতা,ন্যায়বিচার, সৃজনশীলতার প্রকাশ। থাকবে পেশাগত প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্মোহ ত্যাগের প্রতিফলন।পরবর্তীরা যে ত্যাগের গল্প করবে,আবেগে  আনন্দাশ্রু ফেলবে।জাতির জন্মের পেছনে গল্প থাকলে জাতি পথ হারায়না।প্রতিটি সংকটে সম্ভাবনার পথ রচনা করে। আমরা জার্মানি,ইতালি,জাপান তুওরস্কের দিকে তাকালেই এই সত্য উপলব্দি করতে পারি।   

বাংলাদেশ বাঙালি জাতির পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অধিবাসী। একে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে রাখবার জন্য একটা গল্পের প্রয়োজন। এ-ই গল্প হতে হবে বৈচিত্রপূর্ণ।চরিত্র হতে হবে বহুমুখী ; কিন্তু সকল চরিত্র এসে এক বিন্দুতে মিলিত হতে হবে।আমরা কী তেমন গল্প রচনায় এগুচ্ছি? না,আমার পর্যবেক্ষণে বহুর মধ্যে একের সন্ধান এখানে অনুপস্থিত।যাঁরা একীভূত একটা জাতির স্বপ্নকে গল্পের মধ্যদিয়ে,জীবনের মধ্য দিয়ে রূপায়িত করতে চেষ্টা করছে,তারা দৌঁড়ের উপরেই আছে।তারা কেউ হচ্ছেন গৃহহারা, কেউ হচ্ছেন ছন্নছাড়া। তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রাষ্ট্র নেই। এখানেও ভারত বিভক্তির সময়কার বুদ্ধিজীবীদের হীনমন্যতা ও অদূরদর্শীতার অগণিত প্রমান আছে।একদিকে আছে,সর্বজ্ঞানের অধিকারী আমলাগণ যাদেরকে আমি মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে তুলনা করে থাকি,অন্যদিকে আছে  ফরমায়েশি বুদ্ধিজীবী ; তাণ্ডবে জাতির স্বপ্নের গল্প বলার পথ রুদ্ধ হয়ে গ্যাছে। তাহলে কি আমরা অদেখা এক অলঙ্ঘনীয় ভাঙ্গনের পথে আছি?এজন্য সত্যি আমি হতাশ!

এবং যেহেতু গল্পের শক্তিই রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের নির্ণায়ক, সেহেতু আশা ও ভালবাসার গল্প দিয়েই সম্ভাবনার শিল্প নির্মিত হওয়া উচিত।এ-র মধ্য দিয়ে পরষ্পর গভীর প্রেমে আবদ্ধ একটা জাতি রাষ্ট্র নামে প্রতিষ্ঠানে কল্যাণকর জীবনের স্বাদ পায়।

১২/০৯/২০২২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Printfriendly

Featured Post

জাতি নির্মাণে গল্পযোগ

  জাতি নির্মাণে গল্পযোগ   ১ ।   মানুষ সামাজিক জীব।তারা পরিবার গঠন করে।তারপর সে-ই পরিবার একটি গোষ্ঠীতে রুপান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে একাধিক গোষ...