প্রধান শিক্ষকের
আত্মকথা:পর্ব-৩
দিন পনের প্রচুর ঝামেলার মধ্য দিয়ে কেটেছে।মাঝে মাঝে উপজেলায় বিভিন্ন মিটিং এ যেতে হয়েছে।প্রধান শিক্ষকদের মজলিসে বসতাম।একজন একেক রকম বুদ্ধি দিলেন।কেউ কেউ হাস্যরসে একহাত দিলেন;বল্লেন, শেষতক চেয়ারটা ভাগিয়ে নিলেন জহির সাহেব।
মাঝেমাঝে নিজেকে অসহায় মনে হয়।ভাবি,আমি কী অপরাধ করেছি ?উত্তর পাইঃনা।১৯৮৬ সালে বিএসসি পাশের পর সহজেই একটি সরকারি চাকুরী নিতে পারতাম।সে সময় এরশাদের জাতীয় ছাত্র সমাজের ব্যানারে ক্যাডার সার্ভিসে চাকুরী জুটানো কঠিন ছিলনা। এই সময়ে বহু বিসিএস প্রার্থী স্নাতক(পাস) পাশের পরই গেজেটেড মার্যাদার চাকুরী পেয়েছিল।সেবার ব্রত হিসেবে শিক্ষকতাকে অতি উত্তম মনে হয়েছিল।অন্যদিকে আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী এরশাদের আগমনকে কখনো সমর্থন দেয় নাই।এই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নব্য কোটিপতির জন্ম হয়েছিল।সরকারি গুদামের চাল বিক্রি করে অনেক ব্যক্তি জাতে উঠেছিল।তারা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারত।আমাদের মত পরিবারের ছেলেদেরই সমস্য হল।আমরা পারিনি।
একদিন আলিমুদ্দিন স্যার বিনীত স্বরে ডাকলেন।চা দোকানে বসে বসে বেশ কিছু কথা বললেন;যা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বললেন,কমিটির সদস্যদের সাথে অতিরিক্ত মাখামাখি করবেন না;আবার তুচ্ছও ভাববেন না। তাহলে ঝামেলায় পড়বেন।কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কমিটির কাছে অভিযোগ করবেন না। কারণ, এদের অনেকের সুশিক্ষার অভাব আছে, কারো কারো তেমন পড়ালেখাও নেই।শিক্ষিত লোকের দোষ তালাশ করা এদের সখ। একই পরিবারে বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ থাকে;এটি মাথায় রাখবেন।পাগলেটে শিক্ষকদের ঘাঁটাবেন না।এঁদের অধিকাংশ সত্যবাদী হয়ে থাকেন।বয়স্ক শিক্ষকদের সম্মান দেখাবেন।দেখবেন,ভাল সময় কাটবে।আর অর্থনৈতিক ব্যাপারে সততা বজায় রাখবেন।'ভাগকর আর ভোগকর ' এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।আপনি ছাত্রজীবনে ভাল ছাত্র ছিলেন।আপনি চাইলেই সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হবেন।
তার প্রতিটি কথা মনে রাখার মত।তাঁর সুনাম আছে।ছাত্র জীবনে প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন।তার স্কুলের শিক্ষকগণ তাঁকে ভয় এবং সমীহ করেন।তিনি ক্লাসের বারান্দা দিয়ে হাঁটলে অনেকের কথা বন্ধ হয়ে যায়।তবে তিনি কোন শিক্ষককে কখনো বিব্রত করেননি।তিনি কখনো একা ডেকে কথা বলেন,কখনো শিক্ষক কাউন্সিলে বসলে সামষ্টিকভাবে শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতার বিষয় উল্লেখ করেন।তাঁর স্কুলের বহু ছাত্র পেশাগতক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় উন্নতি করেছে।
তার সাথে আলাপের পর মনে জোর পেলাম।তিনি আমার নিয়োগের বিষয়ে কিছুই বললেন না।
নতুন অভিজ্ঞতা:
সেপ্টম্বরের শেষ সপ্তাহে ইউ এন ও অফিসে যেতে হয়েছিল।সেখানে বদুমিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের কমিটির কয়েকজন লোক এসেছিল। আমাদের পাশের গ্রামের স্কুল এটি। তারা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ নিয়ে এসেছিল।প্রথম অভিযোগ হচ্ছে,তিনি খুবই খারাপ।তিনি নিজের মত স্কুল চালাচ্ছেন,কারণে অকারণে শিক্ষকদের ছুটি দেন,ইচ্ছেমত খরচ করেন,কোন ক্লাস নেননা,নেতাগিরি করেন,এখানে সেখানে শালিস করে বেড়ান,দু'একজন মেডাম প্রায়ই স্কুলে দেরি করে আসেন । ইউ এন ও সাহেব তাদের দরখাস্ত রেখে যেতে বললেন।তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,স্কুলের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল কী রকম? উপস্থিত ব্যক্তিগণ একে অন্যের দিকে তাকালেন।উত্তর দিতে পারলেন না।তখন আমার দিকে তাকালেন।আমি বললাম,১৯১৩ সালে জেএসসি তে শতভাগ পাশ করেছে এবং ১৯১৪ সালে এসএসসি তে শতকারা নব্বই ভাগ।ইউ এন ও সাহেব বললেন,স্কুলের রেজাল্ট ভাল হলে প্রধান শিক্ষককে ভাল বলতে হয়। লোকেরা কোন কথা খুঁজে পেলনা।ঘটনাটি আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিল।
প্রথম এস এস সি পরীক্ষার ফরম ফিল আপ
এরই মধ্য এস এস সি টেস্ট পরীক্ষা শুরু হল।কমিটির সভাপতি কমিটির সভা আহবানের অনুরোধ করলন।ম্যানেজিং কমিটির সভা ডাকা হল।অভিভাবক
সদস্যদের দাবী, এবার শতভাগ পাশ চাই।আলোচনা শুরু হল।বিজ্ঞসভ্যবৃন্দ মতামত দিলেন।তারা প্রায় সকলে একবাক্যে
সিদ্ধান্ত দিলেন ;টেস্টে সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ না হলে
ফর্ম ফিল আপের জন্য অনুমতি দেয়া হবে না।তারা
শিক্ষক প্রতিনিধির মতামত চাইলেন।
তাদের একজন বললেন,দুই তিন বিষয়ে ফেল করলে তো বোর্ডই ঐ সব বিষয় পুনঃপরীক্ষার
সুযোগ দেয়।আমরাও তো দিতে পারি।অন্যদিকে এরা স্কুল থেকে দূরে থাকলে হতাসাগ্রস্ত হয়ে
পড়ে।অতএব আমি মনে করি,সকল শিক্ষার্থীদের এলাউ করা উচিত।
" আপনি এলাউ করেন।ভাল।পাশের হারে পতন হবে।শেষে সবার MPO
নিয়ে টানা টানি হবে।কারণ দর্শাও নোটিস আসবে।আপনারা কী তা চাহেন?"জনৈক সদস্য বললেন।
"আমি আমার অভিমত দিলাম। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের।"
"আপনারা নাম্বার হাতে রেখে খাতা কাটবেন।তাহলে ছাত্র ছাত্রীরা ভয় পাবে।পড়া লেখা করবে।"একজন সদস্য মত দিলেন।
সর্বশেষে, সদস্যগণ সিদ্ধান্ত দিলেন ;একশত কুড়ি জনের মধ্যে সত্তর জনকে এলাউ করা হবে।
যথারীতি টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো।সত্তরজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হল এবং ফরম ফিল আপ ফিস নির্ধারিত হল।সত্তরজন ফরম পূরণ করলো।এর পরে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিল।অভিভাবক প্রতিনিধি রহমত মোল্লা একটি স্লিপ পাঠালেন। সেখানে চারজন শিক্ষার্থীর নাম ছিল।তিনি প্রত্যেকের বিপরীতে দুই হাজার টাকা করে দিলেন।আমি বড়ই বিপন্ন বোধ করলাম।এর পর পর এলো আরও পাঁচটি স্লিপ। পাঠিয়েছেন অন্য এক সদস্য।তিনিও দুই হাজার করে পাঠালেন।কেউই অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য টাকা দিলেন না।আমরা তাদের ফরম ফিল আপ না করিয়ে পারলাম না।আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ কিছু বলতে ছেয়েছিলেন।কমিটির সদস্যগণ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,সমাজের প্রতি আমাদেরও দায়িত্ব আছে।পাঁচ বছর পড়াবার পর এদেরকে পরীক্ষার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করবেন।তা হয় না।আপনারা শিক্ষকেরা বছর বছর পাশ করিয়ে উপরের ক্লাসে তুলে দিয়েছেন;আর এখন বাচ্ছাদের ফেল করাচ্ছেন।গাছে উঠিয়ে দিয়ে মই কেড়ে নিচ্ছেন।এখন বলুন, শিক্ষার্থীরা ফেল করল কেন?দেখতেছিতো :অধিকাংশ শিক্ষক ধান্দাবাজির সাথে জড়িত।ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পড়া ক্লাসে বুঝেনা;প্রাইভেটে বুঝে।কী বিষ্ময়কর বিষয়! আমরা যখন ছাত্র ছিলাম শুধুমাত্র রমজানের বন্ধে প্রাইভেট পড়তাম।স্যারেরা, অযৌক্তিক কারণে কোন শিক্ষার্থীকে ফেল করাতো না।বলুন তো,আম কী ভুল বলেছি?
অন্য একজন বললেন,আপনারা দেশের জনগণের ট্যাক্সের
টাকায় পড়ালেখা করেছেন।সুতরাং আপনারা শুধু নিজের লাভ খুজলে চলবেনা।
সবাই চুপ।আমিই বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন।
"আরে এখনতো ছাত্র ছাত্রী প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষক তাদেরকে কৌশলে টিজ করে।সামান্য অজুহাতে পিটানো হয়।আর যদি বাইরে কারো কাছে পড়ে তবে তো মহাভারত অশুদ্ধ হল।আমাদের কাছে এসব অভিযোগ আসে।"
"আপনাদের যদি এত টাকাওয়ালা হবার সখ,তা হলে অন্যকিছু করুন।এই মহান পেশাকে কলংকিত করার দরকার কী?"
আমার মনে হল: তাদের সকলের কথায় যুক্তি ও সমাজের প্রতি দরদ আছে।আলিমুদ্দিন স্যার বলেছিলেন,সকল মানুষের মাঝে সততা ও সম্ভাবনার দিকটি খুঁজবেন।
যাদের স্লিপ দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে
পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।অবশেষে, তাদের কথাই রাখা হলো টেস্টে ছয়-সাত বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের
ফরম ফিল আপ হলো।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত ক্লাসে অংশ নিল।তারা জানালো ,তাদের প্রায় প্রত্যেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছে।কিন্তু আমরা অর্থনৈতিক দিকে পিছিয়ে পড়াদের অতিরিক্ত ক্লাসের টাকা আদায়ে চাপ দিই না।স্লিপে আগত অধিকাংশই অতিরিক্ত ক্লাসের ফিস আর দিতেই পারে নি;অথচ পরীক্ষার্থীরা কম-বেশ টাকা দিয়েছে।ফলে অতিরিক্ত ক্লাস করেও পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থীর কোচিংএর টাকা শিক্ষকগণ পায়নি।
আমাদের
শিক্ষকদের মধ্যে অলিউল্যা সাহেব ঐ টাকা আদায়ে জোরাজোরি করতে নিষেধ করলেন।তিনি
বললেন,দীর্ঘদিন অনিয়মের মধ্যে বিদ্যালয় চলেছিল।ফলে কমিটির অনেক সদস্য এটাকে
স্বাভাবিক মনে করে অথবা তাদের অধিকারে অংশ মনে করে। গত বছর তো ফরম
পিল আপের টাকা স্কুল কমিটি জমা নিয়েছিল।সে যে কী বিতিকিরিচ্ছি কাণ্ড!নবীনেরা বললেন, আমরা ছাত্রছাত্রীদের থেকে টাকা চাইব।দেখবেন,ওদের গোমর ফাঁস হয়ে
যাবে।
আমি বললামঃযামেলা বাড়িয়ে লাভ
নেই।সামনের দিন গুলোতে এই রকম অবস্থায় যেন না পড়ি সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।যথা
সম্ভব সকল শিক্ষার্থী যাতে যোগ্য বিবেচিত হয়; সে ব্যাবস্থা নিতে হবে।এই জন্য আমরা
নতুন পরিকল্পনা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।