শিক্ষায় সৃজনশীলতা অর্জনে অন্তরায়সমূহঃপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ
সৃজনশীলতা একটি ইতিবাচক
শব্দ ; যার মধ্যে নবতর সৃজনের প্রচেষ্টা লুপ্ত আছে।উন্নত উত্তরসূরী সৃষ্টিতে
শিক্ষায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় ।বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই প্রত্যয়ে বহুতর
পদক্ষেপ নিচ্ছে।তবুও কাংখিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।তাহলে এর পেছনে বাধা
কোথায় ?আমরা তা বের করার চেষ্টা করব।
আমি এর পেছনে যে কারনসমূহ
রয়েছে বলে মনে করি – তা হয়তো আপনারা কেউ কেউ চিন্তা করছেন ।
শিক্ষায় সৃজনশীলতা অর্জনে
অন্তরায়সমূহঃ
১।সমন্বয়ের অভাব
২।মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতাহীন
ব্যক্তিবর্গ সুপারিশকারী
৩।শিক্ষকের যোগ্যতা এবং দক্ষতার
অভাব
৪।যথাযত প্রশিক্ষণের অভাব
৫।ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত
৬।প্রতিষ্ঠান প্রধানের
ভূমিকা
৭।পরীক্ষা পদ্ধতির ত্রূটি
৮।নিয়োগ ও পদোন্নতির ত্রূটি
৯।বিবিধ
এখন আমরা উল্লিখিত সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করি ।
১। সমন্বয়ের অভাবঃসৃজনশীলতা অর্জনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সকল স্তরে সুষম
সমন্বয় ।এই ক্ষেত্রে এটি অনুপস্থিত।শিখায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার প্রত্যয় ঘোষণার
সাথে সাথে শিক্ষক নিয়োগেও সতর্ক থাকা দরকার ছিল ।এইক্ষেত্রে আমরা দেখি এই সময়েও
প্রাথমিক স্তরে ৬০% নারী কোঠা বরাদ্ধ রাখা হয় এবং এদের নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা
চাওয়া হয় SSC পাস ।তদুপরি , আরও
বিভিন্ন ধরণের কোঠা এবং দুর্নীতির কারণে তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতার শিক্ষক নিয়োগ
পায়। আমরা জানি, সৃজনশীল মানুষই পারে সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করতে।কিন্তু গুনগতমানে
ঘাটতি নিয়ে শিক্ষকতায় আগমন যাঁদের আগমন
তারা কোনস্তরের গুণগতমান সমৃদ্ধ জাতি উপহার দিবেন তা প্রশ্নবিদ্ধ।ফলে কোটার বোঝা
ত্রিশ বছর বইতে হবে।
২।মাঠপর্যায়ে
অভিজ্ঞতাহীন ব্যক্তিবর্গ সুপারিশকারীঃমাঠপর্যায়ে
অনভিজ্ঞ ব্যাক্তিবর্গ এবং কর্মকর্তাগণ শিক্ষায় সুপারিশকারী এবং প্রশাসনিক
কর্মপদ্ধতি পরিচালনা করেন। যদিও শিক্ষকের কাজ
এবং শিক্ষায় কর্মপন্থা গ্রহণ একজন চিকিৎকের চেয়া কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ,
শিক্ষার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের সাফল্যই একজন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীকে
কাংখিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে ।ফলে যা হবার তা হলো।
মাঠপর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত
শিক্ষা অফিসারগণের (মাধ্যমিক) অধিকাংশেরই শিক্ষায় (বিএড বা এমএড) ডিগ্রী
ছিলনা।অন্যায্য সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে একটা গোষ্ঠী এঁদেরকে প্রকল্পে নিয়োগ দিয়েছিল
।কিন্তু দেশের কী লাভ হল? ফলে মাধ্যমিক পর্যায়ে সমস্যা চিন্থিত করে এর সম্ভাবনাকে
কাজে লাগানো এঁদের পক্ষে অসভবই হল।অন্যদিকে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির
অযোগ্যতা এবং দুর্নীতি শিক্ষায় গতিশীলতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।সাম্প্রতি প্রকাশিত
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়ঃ বিদ্যালয়ে প্রতিটি নয়োগে সর্বোচ্চ
দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেন্দেন হচ্ছে।কারা এর পেছনে আছে কিংবা
কারা সহযোগিতা করছে তা সর্বসাধারণের জানা বিষয়।এমনও দেখা গেছে – পছন্দের প্রার্থী
নিয়োগ পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ না হওয়ায় নিয়োগ কমিটির সুপারিশ প্রহণ করা হয়নি।যদি এমন
হয় কী করে সৃজনশীলতা অর্জিত হবে ?
৩।শিক্ষকের
যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবঃএকটা সময় ছিল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সেবার ব্রত নিয়ে
শিক্ষকতায় আসতেন। আমাদের ছাত্র জীবনেও আমরা এমনটি দেখেছি ।বর্তমানে অধিকাংশ
ব্যাক্তি শিক্ষকতা পেশায় প্রজম্মকে স্বপ্ন দেখাতে আসেন না ; বরং স্বপ্ন হারিয়েই
তাদের আগমন।ফলে ইচ্ছের দৈন্যতা তাদের গুণগত মানকে ধ্বংস করে দেয়।এক্ষেত্রে বিজ্ঞান
বিভাগের শিক্ষক এবং ইংরেজি বিষয়ের দেশব্যাপী বদনাম রয়েছে। শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে সরকার বহুবিদ
পদক্ষেপ নিয়েছে।বিগত প্রায় দশককাল ধরে তা চলে আসছেচদাতা সংস্থা থেকে গৃহিত ঋণ বা
অনুদানের উপর ভিত্তি করে ট্রনিংসমূহ চলছে।উপর থেকে নিচে প্রায় সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত
ব্যাক্তিবৃন্দ এর আওতায় এসেছেন।এখানেও সরকারি অর্থ হরিলুটের সংবাদ কমবেশি সবাই
জানি।
ট্রনিং ম্যানুয়েল এবং
ট্রেনারের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।অন্যদিকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ
ট্রেনিং এ অর্জিত জ্ঞানকে পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে এসে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন ।অধিকাংশ
বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের অনুশীলন করেন না ।কারণ,তাঁরা এর গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হচ্ছেন ।
শিক্ষকগণের অতিরিক্ত
ক্লাসের চাপ থাকায় অর্জিত জ্ঞানের অনুশীলন করতে পারেন না বলে অভিমত দেন ।অধিকাংশ
শিক্ষক সপ্তাহে ২৫ থেকে ২৭ টি ক্লাস নেন।ফলে তাদের পক্ষে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়
না ।সত্যি কথা হচ্ছে এই বিষয়ে বাধ্যবাদকতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অন্যদিকে শিক্ষক হিসেবে
নিয়োগপ্রাপ্ত বহু শিক্ষক আছেন যাদের বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় দখল নেই ।যারা শুদ্ধ
উচ্চারণে বাংলা বলতে যেমন ব্যর্থ তেমনি সৃজনশীল প্রশ্ন প্রনয়নেও অদক্ষ।
এর থেকে মুক্তির জন্য
ইংরেজির মত ভাষাগত দক্ষতা প্রমাণের চারটি ক্ষেত্রের প্রতি নজর দেয়া উচিত। সর্বোপরি
সৃজনশীল মনন ও মানসিকতা সম্পন্ন মানুষকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসতে হবে ; তবেই
কাংখিত সাফল্যের দেখা মিলবে।
৪।যথযথ
প্রশিক্ষণের অভাবঃপ্রতিটি পেশাগত ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ হিসেবে সুনির্দিষ্ট কর্মকাল ব্যয় করা প্রচলিত পদ্ধতি ।শিক্ষনবিশ
হিসেবে সাফল্যের উপর ভিত্তি করে নতুন পেশাজীবিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়।কিন্তু
বাংলাদেশে শিক্ষকতায় এই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।ফলে আগ্রহী শিক্ষকের সামর্থ ও
প্রবণতা সম্পর্কে না জেনেই নিয়োগ প্রদান করা হয়।
নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণের
দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ; এর মাধ্যমে শিক্ষায় নবতর উদ্ভাবন
এবং প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বহুবিদ জানা ও প্রয়োগের সুযোগ থাকে। সাথে সাথে পারষ্পরিক
মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের ক্রমিক পদ্ধতির প্রচেষ্টা নেয়া
যেতে পারে।
ছাত্র-শিক্ষক
অনুপাতঃঅদ্যবদি বাংলাদেশে
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যৌক্তিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়নি।ফলে শিক্ষক যাথযথভাবে
শিক্ষার্থীদের শিখণ-শিক্ষণ প্রক্রিয়া চালাতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীর
সামর্থ ও প্রবণতা বিবেচনা করে প্রয়োজনে শিক্ষ্ররথীদের একাদিক ভাগে বিভক্ত করে শেণি
কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন হয়।শিক্ষক স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়না।
প্রতিষ্ঠান
প্রধানের দায়িত্বঃপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক তার দক্ষ নেতৃত্বের
মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ উন্নত করতে পারেন।তার দূরদর্শিতা সৃজনশীলতাক
অর্জনকে নিশ্চিত করতে পারে।এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়।প্রশিক্ষিত
শিক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রনয়নে তিনি বাধ্য করতে পারেন ।কিন্তু তা সম্ভব
হচ্ছে না।
পরীক্ষা
পদ্ধতির ত্রুটিঃ বাংদেশে পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই ত্রুটিপূর্ণ।দ’বছর ধরে পঠিত বিষয়সমূহের মূল্যায়ণ
একসাথে করা হয়;যা শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা স্বরুপ।এটি শিক্ষ্ররথীর মানসিক অবস্থাকে
সংঘাতপূর্ণ করে দেয়।এরকম ভীতিকর ব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি সফল হতে পারে না। পাবলিক
পরীক্ষায় মূল্যায়নকে সিমিত করে বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ণকে প্রতিষ্টিত করা উচিত
।সাথে সাথে সেমিস্টার পদ্ধতি চালুর বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত ।
এখানে একটা বিষয় সকলের নজরে
আনা উচিতঃআমাদের পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে একজন শক্ষার্থীর শুধুমাত্র লেখার দক্ষতা
পরিমাপ করা হয় ।কিন্তু তাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ।দূর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত বোর্ডগুলো
তার প্রমাণ রেখছে।
নিয়োগ
ও পদোন্নতির ত্রুটিঃ বাংলাদেশে শিক্ষক বাচাই
থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত অধিকাংশই দূর্নীতিগ্রস্থ গোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত
।ফলে অসচ্চ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আগত শিক্ষকদের আনেকেই অযোগ্য ।অন্যদিকে সরকারি কিংবা
বেসকারি কোন পর্যায়েই প্রতিযগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে পেশাগত পদোন্নতিকে প্রধান
নিয়ামক হিসেবে রাখা হয়নি। অতএব সরকার যদি সৃজনশীল পরবর্তী প্রজম্মের আভির্ভাব
প্রত্যাশা করে তাহলে অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থকতে হবে।
শিক্ষা একটা জাতির ভবিষ্যত
নির্ধারণ করে দেয়।কিন্তু এই সত্যটিই আমরা অনুভব করতে অসমর্থ হচ্ছি ।ফলে শিক্ষা
খাতে সরকারের বিনিয়োগ খুবই কম।এই আর্থিক দীনতা মানবিক বৈকল্য সৃষ্টি করছে।
সরকার দেশকে উন্নত বিশ্বের
কাতারে নিয়ে যেতে হলে শিক্ষাখাতে নিনিয়োগ বাড়াতে হবে।দেশপ্রেমে উজ্জিবিত
শিক্ষাবিদগণের সুপারিশ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।তবেই উন্নত
বিশ্বের কাতারে যাবার স্বপ্ন সত্যি হবে।
বর্তমানে শিক্ষাক্রমে
কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা উচ্চারণ রীতি অন্তর্ভুক্ত করা
হয়েছে।প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষক নিয়োগে সর্বনিম্ন যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক করা
হয়েছে।কিন্তু উন্নত জাতি বিনির্মানের জন্য আরো বহুদূর যেতে হবে।
---------------------