প্রধান শিক্ষকের আত্মকথা:মোবাইল সমাচার ও অন্যান্য
কিছুদিন পূর্বে দশম শ্রেণির
ছাত্রছাত্রীদের বললাম,তোমরা আমাকে বলতো দেখি, তোমাদের পড়ালেখার অবনতির কারণ কী?
শিক্ষার্থীরা সবাই একবাক্যে বলল,স্যার মোবাইল। অথচ তারা এর পাশাপাশি অলসতা আর
শিক্ষকের পাঠ উপস্থাপনা ভাল না লাগাকে দায়ী করে।
অক্টোবর শেষ হয়ে আসছে। অষ্টম শ্রেণির জন্য অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষা শুরু হবে।আমার বিদ্যালয়ে পুরোনো
নতুনে মিলে মাত্র আশিজন পরীক্ষার্থী। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ।শিক্ষক কাউন্সিলে একটি সভা করা দরকার;যাতে দশম শ্রেণির ফলাফল প্রকাশ করা ছিল অন্যতম এজেন্ডা। পরীক্ষা
চলাকালীন সময়ে ৬ষ্ঠ,৭ম এবং নবম
শ্রেণির শ্রেণি কার্যক্রম কিভাবে চালানো যায় কী না তা নিয়ে
আলোচনা, ফরম পুরণসহ সাথে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল।
মিটিং শুরু হল।পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের
পরেই ওলিউল্যা স্যার বললেন,বোর্ড থেকে একটা
চিঠি এসেছে।পেয়েছেন কি?
: কই,নাতো।কখন এলো?
: এইতো আজ সকালে।
:দিনতো দেখি।এটা তো দেখছি এস.এস.সি পরীক্ষক তালিকা আপডেট করে পাঠানোর
চিঠি।
অত:পর আমি সহকারী প্রধান শিক্ষককে এটি যথাযথভাবে পূর্ণ করার জন্য অনুরোধ
করলাম।সাথে নির্দেশনা অনুযায়ী Online এও প্রেরিত তথ্য সংশোধন
করার নির্দেশ দিই।
এইবছর বোর্ড এস.এস.সি ফরম পুরণে অরাজকতা বন্ধে কতিপয় শক্তিশালী পদক্ষেপ
নিয়েছে।প্রথমত নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ফরম পুরণ না করা, বিগত বছরে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের
আবশ্যিকভাবে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলের ডাটা Online এ ফরম পুরণে আগে প্রেরণ করা,নির্বাচনী পরীক্ষার খাতা সংরক্ষণ করা ইত্যাদি।বিদ্যালয় পর্যায়ে দুর্নীতি
রোধকল্পে পদক্ষেপসমূহ শিক্ষকদের কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছে।অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ
হওয়ার আগেই আমদেরকে দশম শ্রেণির ফরম পুরণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে
হবে।প্রথমেই দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল সীট নিয়ে আলোচনা হল।দেখা গেল
আমাদের সোনার ছেলেদের মধ্যে মাত্র দশজন সকল বিষয়ে পাশ করেছে।একবিষয়ে ফেল করেছে সাত
জন।দুই বিষয়ে ফেল করেছে দশ জন।সব হিসেব নিকেশ করে দেখা গেল:চার বিষয় পর্যন্ত ফেল
করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা চল্লিশজন।গত বছরে এক,দুই বা তিন বিষয়ে ফেল করেছিল ত্রিশ
জন।
পরীক্ষকেন্দ্রে দায়িত্ব থাকায় আমি কয়েকদিন স্কুলে অনিয়মিত ছিলাম।সহকারী প্রধান শিক্ষক ফেল করাদের পাশ দেখিয়ে বোর্ডে
ফলাফল প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন।
ফরম পুরণের অভিযোগ ও মোবাইল সংবাদ :
ফরম পুরণের জন্য দেয়া নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে জনৈক অভিভাবক এলেন।তাঁর মেয়ে
আট বিষয়ে ফেল করেছে।তার অভিযোগ হচ্ছে,স্যারদের
কাছে প্রাইভেট না পড়ায় মেয়েটিকে ফেল করানো হয়েছে।অভিযোগ খুবই গুরুতর। আমি জমা দেয়া
উত্তরপত্রগুলো দেখলাম।ভদ্রমহিলাকে বললাম,মেয়েটি যা লিখেছে
তাতে পাশ করা অসম্ভব। আপনি কি খাতাগুলো দেখবেন?
:না,স্যার।
:তাহলে বলুন,মেয়েটি পরীক্ষায় এত খারাপ ফল করার
কারণ কী?মেয়েটি কি বাড়িতে পড়া-লেখা করেনি?আর যা দেখলাম মেয়েটি ত্রিশ দিন স্কুলেই আসেনি।এমনটি হলে যে পাশ করার
কোন কারণই নেই।
:কি বলব স্যার,মেয়েটির বাবা কি একটা টাচ মোবাইল
দিয়েছে।সেই থেকে মেয়ের পড়া নেই,লেখা নেই ;শুধু ঐদিকে থাকে।ঘুম নেই,নিদ নেই।
মহিলার আক্ষেপের সাথে তীব্র হতাশা প্রকাশ পেল।
:ভালোইতো; মেয়ে এখন টাচ নিয়ে থাকুক;পরীক্ষা নাই বা দিলো। আর দেবারও সুযোগ নেই।
ঘুরতে ঘুরতে পিয়ন তনু মিয়া এদিগে এসেছিল।তনু মিয়া মাঝ বয়সী।
সে শুনলো।কিছুক্ষণ পরে সে বলল,স্যার ইনার মেয়ে পরী; আস্ত একটা শয়তান
মেয়ে।স্কুলে মোবাইল আনে।হুজুর স্যার ধরেছিল।কি সব আজে বাজে ভিডিওতে ভরা।ঘেন্না
লাগে।ঐদিন তো স্যারেরা বলেছিল,এই মেয়ে দশটা
ছেলে মেয়েকে নষ্ট করবে।আরো কতকিছু আছে।অতকথা বলতে পারবো না।
এটা শুনে নেকাবে ঢাকা অর্ধবয়স্ক মহিলা নীরবে উঠে গেলেন।
শেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহার নিয়ে সরকারিভাবে মাঝে মাঝে সতর্কতামূলক প্রজ্ঞাপন
দেয়া হয়।সম্প্রতি এই রকম একটি প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।যেখানে বলা হয়েছে,শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কেউ মোবাইল আনতে
পারবে না বা ব্যবহার করতে পারবেন না ।নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ
নির্দেশনা।কিন্তু এই নির্দেশের বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।এটিও আমাদের ওলি উল্যা স্যারের
নজরে আসল।তিনি মনে করেন,এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
গেলে বা প্রতিরোধ করতে গেলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা
হয়নি।ফলে এটি শুধুমাত্র একটি কাগজ ছালাছালিতেই শেষ হবে বলে মনে হয়।অন্যদিকে,বৃট্রিশ
কাউন্সিল কর্তৃক প্রেরিত ইংরেজি শিক্ষণে সহায়ক উপকরণ হচ্ছে মোবাইল; এর মাধ্যমেই প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের অডিও শোনানো হয়।এখন এই নিষেধাজ্ঞা প্রেরণের ফলে এই অতি
প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার হুমকীর মুখে পড়বে।।সাথে সাথে শিক্ষার্থীর মোবাইল ব্যবহার
নিয়ন্ত্রণ আনা এই মুহূর্তে অসম্ভবই বলে মনে হচ্ছে।প্রজ্ঞাপনের আজ্ঞায় শিক্ষক
শিক্ষিকাগণ বন্দী ;কিন্তু
ছাত্রছাত্রীরা যে নয় তা শতভাগ সত্য।
অবস্থা দৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের
নিয়ন্ত্রণ এখন আর আমাদের হাতে নেই;আজকাল এইক্ষেত্রে মাতাপিতাও অসহায়।সংস্কৃতির অসম
বিস্তার সবকিছুকেই ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে।ছাত্রছাত্রীদের কাছে শক্তিমান
রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।ফলে তাদের নির্দেশ আর
নির্দেশনা কিশোর কিশোরীর কাছে শিরোধার্য।এইতো কিছুদিন
আগে স্কুলের কিছু ছাত্র অমুক ভাইয়ের নির্দেশে মিটিংএ গিয়েছে।আমাদের কিছুই করার
ছিলনা।কী ব্যাপার, আপনারা যে নিরুত্তর!
আমরা শুনছি তো।যাদের ডাকে এই অবুঝ শিশুরা ঘর আর ক্লাস ছেড়ে যাচ্ছে, তাদের পুত্র কন্যারা কেউই মিছিলে যায় না।এটা এদের কে কে বোঝাবে?
বিশেষ করে প্রবাসীদের সন্তানেরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে।অনেক
মাকে বলতে শুনেছি:মোবাইল,হোন্ডা না হলে ছেলে স্কুলেই আসবে
না।ছেলেরা সেই সব পাচ্ছে;আর স্কুল থেকে সরে যাচ্ছে।
তিন বছর আগে পাঁচ সাতটা ছেলে সমাবেশের আগমুহূর্তে জটলা করছিল।তনু মিয়া কিছু
একটা অনুমান করে এবং উঁকি দিয়ে দেখে।তার চক্ষুচড়কগাছ।এরা সবাই অষ্টম শ্রেণির
ছাত্র।পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল,আমাদের সাবেক ছাত্রী হাসিনার
ছোট ভাই মোবাইল এনেছে।সাথে ছিল মেমোরি ভর্তি নিষিদ্ধ ভিডিও। স্থানীয় বাজারের
মেমোরি লোডের অপার থেকে কম দামে কিনেছে।ছেলের মায়ের লজ্জায় মাথা হেট।তারা তো ওইসব
জানেই না ; কী হচ্ছে আর কী ঘটছে?
"হ্যাঁ ,শিক্ষক সম্প্রদায় তো ধোয়া
তুলসী পাতা।তারা যে কত বিপদজনক তা কারো অজানা নয়।পরিমলেরা রাজনীতির কাঁধে ভর করে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে এবং এরা খুবই শক্তিশালী।খোঁজ নিয়ে দেখুন ;অনেকের আমলনামা দেখলে গাঁ শিহরে উঠবে। " জয়নাল স্যার বললেন।
"তা ঠিক।কিন্তু , পেশার ধরণ আর
অবস্থানগত কারণে এদের অধিকাংশকে ভালো থাকতেই হয়।সবস্থানেই মন্দ চরিতের উপস্থিতি
থাকতে পারে।তবে তা কতটা বিপদজনক মাত্রায় আছে তা দেখা যেতে পারে।মাঝে মাঝে আশে পাশের অনেক স্কুলের শিক্ষকদের অনৈতিক আচরণের সংবাদ আসে।বিচার সভা
বসে।স্বাক্ষীহীন অভিযোগে একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।কিন্তু নিরপেক্ষভাবে খোঁজ
খবর নিয়ে দেখা গিয়েছে যে, সব অভিযোগ অসত্য নয়।নিজের ঘরে এবং বিদ্যালয়ে প্রচণ্ড
নিরাপত্তাহীতা নিয়ে মেয়ে শিশুরা এগুচ্ছে।এই অবস্থা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোন জরীপ
নেই।আমাদের ওলি স্যার এটা নিয়ে নাকি একটি জরীপ চালিয়েছেন।তিনি বলেন,ছাত্রীরা
সবচেয়ে বিশ্বস্থ হিসেবে শিক্ষকদের দেখে।কিন্তু দেখা গেছে,অনেক শিক্ষক না বোঝার ভান
করে ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয়,অনেকে মাথায় সাদা চুল তুলতে দেয়;প্রাইভেট পড়তে গেলে
সুযোগ বুঝে অন্যায্য কাজ করে,বাজে ধরণের উপহার দেয়।এমতাবস্থায় বিব্রত মেয়েরা কাউকে
বলতেও সাহস পায়না।বর্তমানে ইন্টারনেটের উন্মুক্ত ময়দানে শিক্ষকেরা যেমন এগিয়েছে,ছাত্রছাত্রীরাও
নিষিদ্ধ আর গোপন সত্য আবিষ্কারের পথ খুঁজছে ।এখন প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ
করা;তা না হলে নেটের জালে আমাদের পুরো জাতি ধরাশায়ী হবে।"
বোর্ডের পরীক্ষক নির্বাচন :
ওলিউল্যা স্যার বোর্ডের পরীক্ষক নির্বাচনের গাফলা নিয়ে মজা শুরু
করলেন।দেখেন স্যার,ইসলাম ধর্মের স্যার বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষক এবং যথারীতি কাগজও
পাচ্ছেন।বলুন তো দেখি এটা কী করে সম্ভব?
কথা কম বলার মানুষ হুজুর স্যার বললেন,যত দোষ সব নন্দঘোষ! আপনারা কি জানেন, নন্দিনী বিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক দু’বছর ধরে বাংলা বিষয়ের প্রধান
পরীক্ষক।ইনি কোন শ্রেণিতেই বাংলা পড়ান না।তিনি নিচের ক্লাসে গণিত এবং উপরের ক্লাসে
বিজ্ঞান বা কৃষিশিক্ষা পড়িয়ে থাকেন।যেহেতু তিনি আমার প্রধান পরীক্ষক ছিলেন আমি এই
বিষয়ে জেনেছি।স্নাতক পর্যায়ে তাঁর একশ নাম্বারের বাংলা বিষয় ছিল।আমারও তো তা ছিল।
তাহলে সমস্যা কোথায়? আমিতো অষ্টম
শেণিতে বাংলা পড়াই।
সমস্যা তো এখানে না।সমস্যা হল:আপনারা বোর্ডের কেরানী-ফেরানীকে পাঁচশো করে
কেন দিয়েছেন। এতে যিনি যে বিষয়ে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ তিনি কাগজ পাচ্ছেন না।এই যেমন
ধরুন, আমি প্রায় বার
বছর ইংরেজি পড়াচ্ছি।ইংরেজিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছি।তবু আজ অবধি এসএসসি'র ইংরেজির কাগজ পাইনা।আপনি কি মনে করেন আমি কাগজ পাওয়ার অযোগ্য?
: আপনার যোগ্যতা সন্দেহাতীত। আমরা জানি।কিন্তু আপনি যে অফিস বুঝেন না।এই
বলে অট্টহাঁসি দিলেন।
হুজুরের রসিকতায় গভীরতা আছে।তারপর বললেন,কাগজ পেতে হেডম লাগে।শুধু এলেম থাকলে হয়না হেলেমের জোরও লাগে।
হেলেমের জোরেও বোধহয় আর হচ্ছে না।বোর্ডের নতুন কর্তা খুবই কড়া।এইতো গত
সপ্তাহে আমরা উত্তরপত্র আনতে গেলে তাঁর মুখেই কিছু কড়া বার্তা শুনলাম।তিনি স্পষ্ট
বলে দিলেন,কোন প্রধান শিক্ষক যদি পরীক্ষকের জন্য প্রেরিত তথ্যপত্রে অযৌক্তিকভাবে শিক্ষক ও বিষয়
নির্বাচন করেন তবে তাঁকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।
মুনির স্যার বললেন,ওখানে সুলতান
মিয়া আছে।তাকে শ’পাঁচেক দিলে হয়ে যাবে।কে কার খবর কে রাখে।
নীলু ম্যাডাম বললেন,যাই হোক যখন বিষয়টি নিয়ে বলাবলি
আর লেখলেখি হচ্ছে - একটা কিছু তো নড়চড় হবে।সবকিছু যে বেপরোয়াভাবে চিরদিন চলবে তাতো
নয়।একসময় বোর্ডের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ অকল্পনীয় ছিল।আমাদের শাহাদাত ভাইয়ের পরীক্ষায়
ফেল এলে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।তার উত্তরপত্র দেখার সুযোগ পাঁচ বছরেও পাননি।এটি
১৯৮৩ সালের ঘটনা। পরে আবার সববিষয়ে পরীক্ষা দিতে
বাধ্য হয়েছিলেন।সে তুলনায় এখন জবাবদিহিতা বেড়েছে।
আমাদের বিএসসি স্যার বললেন,আমরা
যেইবার বিএসসি পরীক্ষা দিই,সেবার শতকরা পঁচানব্বই জন
ছাত্রছাত্রী রসায়নে ফেল করেছিল।আমরা অনেক পরে জেনেছি,চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় রসায়নের কাগজ মূল্যায়নও করেনি।এর বিরুদ্ধে কলেজগুলো কিছুই করতে
পারেনি।এরশাদশাহীর জামানায় এরকমটি প্রায় ঘটতো।সে তুলনায় অবস্থা এখন অনেক ভাল।কী
বলেন?
আরে আমাদের মধুবাবুও তো গত বছর অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক
ছিলেন।তারও উচ্চমাধ্যমিকের পর ইংরেজি বিষয় ছিলনা।তিনি কিভাবে হলেন?
যতটুকু জানি তিনি একজন প্রধান শিক্ষক ।পড়ালেখা জানেন।বোর্ড়ও দীর্ঘদিনের
অভিজ্ঞতার মূল্য দেয়।
শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব যে ক্রমশ
পড়তির দিকে তা এবারে বোর্ড়ে গিয়ে বুঝলাম।পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শিক্ষকদের অনুরোধ করলেন
যে তারা যেন কোন ক্রমেই তিনশ এর অধিক উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য না নেন।তিনি আরও
বলেন,দেখুন আপনারা অনেকে আমাদের
পিয়নকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে চারশ কাগজও নেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন।এরকম না করার অনুরোধ
করছি।কিন্তু স্পষ্ট নির্দেশও যে কেউ কেউ মানতে অভ্যস্ত নয়।সত্যিই কয়েকজন পিয়নকে
টাকা দিয়ে তিনশএর অধিক উত্তরপত্র নিয়েছে।এই হল অবস্থা।
ওলি উল্যা স্যার আলোচনার বিষয় উস্কে দিয়ে চুপচাপ
শুনেন।কে কী বলেন লক্ষ করেন।
তার অভিমত হচ্ছে, ট্রাডিশনাল বিষয়গুলো
একেবারে ছুড়ে ফেলে দেওয়া নির্বুদ্ধিতার কাজ। আপনারা কী বলেন? আমিও একমত ; কিন্তু কিছু বিষয়ে
বাছবিছারেরও দরকার আছে।অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার নেওয়ার বিষয়ে প্রায় সকল
খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরকার এটি চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন
এদেশে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে গায়ের জোরে আর চেয়ারের জোরে সিদ্ধান্ত হয়।এখানে যে
মাথার বিষয়ও আছে তা মানা হয় না।ফলে সম্ভাবনাময় অনেক মাথা হারিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীর প্রবণতা আর সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করার কৌশল উদ্ভাবন করা
উচিত।একজন শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমের প্রতিটি বিষয়ে আগ্রহ নাই থাকতে পারে এবং এটাই
স্বাভাবিক। এজন্য যে সকল বিষয়ে শিক্ষার্থী সাফল্য প্রমাণে সমর্থ হবে সেসকল বিষয়ের
কোনটিতে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের অধিকার অযৌক্তিক নয়।বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর
মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় বিজ্ঞান এবং গণিত ছাড়া বাকি বিষয়সমূহে অসন্তোষজনক ফলাফল
অর্জন করেছিলেন।ফলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরে তিনি বিজ্ঞান আর গণিত বিষয়ের সাথে
সম্পর্কিত বিষয়েই পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।পরবর্তীকালে তাঁর সাফল্যের ইতিহাস
সকলেরই জানা।আমাদের সমস্যা হল,শিক্ষার্থী
একটিমাত্র বিষয়ে ফেল করলে অনুত্তীর্ণ বলে স্বীকৃত হয়।এটি আমি সুবিচারের অনুভূতিজাত
বলে মনে করিনা।
আমরা সবাই শুনছি।জয়নাল স্যার মুখ খুললেন।তিনি বললেন,ওলি স্যারের কথার উপরে কর নির্ধারণ করা উচিত।ইনি প্রায়শই চলমান পদ্ধতিতে
দোষ খুঁজে বেড়ান।তিনি গতকাল বললেন,পৃথিবীর সকল
খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে চক ডাস্টারে ক্লাস নেয়া হয়;কিন্তু আমরা হঠাৎ করে
মাল্টিমিডিয়ার আয়োজন করছি, যার প্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
আছে।বিদেশী ঋণের টাকা লুটপাটের এই এক মহা আয়োজনের ব্যবস্থা। প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল
ছাপানো,বিতরণ আর লেখা - সবই যে কী মানের অভিজ্ঞ ব্যক্তির
মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণ বুঝতে পারেন। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল লেখকের যোগ্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে ; এদের অনেকে অজ্ঞাত প্রতিষ্ঠান থেকে
ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়ে গলায় ঝুলাচ্ছেন আর দেশবাসীকে মুলো দেখাচ্ছেন।এসব ভূঁয়া
ডিগ্রীদের নিয়ে দিনকয় আগে তালাশে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল।আমাদের
শিক্ষা বিভাগের কর্তারাই এইক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন।
: আমি কি ভুল বলেছি? আপনারা যাচাই
করুন।ওলি স্যার সংক্ষেপে বললেন।
অনেক সময় এজেন্ডাহীন আলোচনা চলে।বিশেষকরে বিরতির সময় রকমারি বিষয়ের বিস্তার
ঘটে।এইক্ষেত্রে ওলি স্যার প্রশ্ন উত্তাপন করেন এবং সমাধানের সূত্র দিয়ে
থাকেন।প্রায় প্রতিদিন এমনটি ঘটে।এইসব আলোচনা আমাদের পারষ্পরিক সম্পর্কে নতুন
মাত্রা দেয়।ইনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি শিক্ষকতাকে উপভোগ করেন এবং একে এক অনন্য
আনন্দের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন।এদিন তিনি পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষক নির্বাচনে
স্বচ্ছতা আনয়নেও একটি উপায়ের কথা বললেন।
বেনবেইজের সাথে সমন্বয় :
পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষক নির্বাচন নিয়ে কথা আলোচনা চলছিল। ওলি উল্যা স্যার
এই ক্ষেত্রে একটি সহজ পথের নির্দেশ দিলেন।তিনি মনে করেন,বোর্ডে শিক্ষকের তথ্য যাচাইয়ে বেনবেইজ দ্বারা গৃহিত তথ্যের সমন্বয় করলে
বোর্ড়ের সুবিধা হবে।বিজ্ঞানের সমন্বয় ও নিঃসরণের বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করলে সুস্থ
শরীরের মত বোর্ড়ও সুস্থ থাকবে।এইজন্য
পরীক্ষক নির্বাচনে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে সংযুক্ত করা উচিত।এতে প্রধান
শিক্ষকগণের চাপ ও ভারমুক্ত হওয়া সহজ হবে।
আসল সত্য হচ্ছে এই যে,যারা নীতি
নির্ধারণ করেন তাদের সন্তানেরা এই সকল বিদ্যালয়ে পড়েনা।ফলে দেশের শিশুদের ক্ষতি
হলে কার কী?হতাশার সুরে ওলি স্যার বললেন।