ভালবাসায়
শিল্প ও শিল্পে ভালবাসা
ভালবাসা
পৃথিবীর আদিমতম শব্দ।সমগ্র বিশ্বমণ্ডল সৃষ্টির সাথে এই শব্দটি যুক্ত;প্রতিটি মহৎ কর্মে এর উপস্থিতি অত্যাবশ্যক।এই অত্যাবশ্যক রূপটি তখনই যথার্থ হবে যখন এটি শৈল্পিক সৌন্দর্যে প্রকাশিত হবে।এটি তখনই সম্ভব যখন ভালবাসায় শিল্পের সৌন্দর্য থাকবে আর শিল্পের প্রতি প্রত্যাশিত ভালবাসার প্রকাশ ঘটবে। । সৃষ্টিকর্তা যখন মানব সৃষ্টি করেন,তখন তিনি বিশেষ উদ্দেশ্য
নিয়েই আদমকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তার গুণ আরোপ
করেছেন যাতে তাঁর সৃষ্টি তাঁকে বুঝতে পারে।এই বুঝতে পারার সাধনাই শিল্পীর কাজ।
সাধারণের চেয়ে একটু আলাদা,একটু ভিন্নতর চিন্তা
থেকে শিল্পের সূচনা।শিল্প নতুন সৃজন; তবে তা অনন্য।আমরা
দিন যাপনে কত কাজ করি।তার সব কিছু শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয় না।শিল্প বৃত্তের বাইরে
চিন্তা করা,একটু ঘুরে আসা অথবা একটু ঘুরিয়ে দেয়ার বাসনা;এই বাসনা থেকেই নিবেদক নিবেদনে নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করে। আর যার বরাবরে
নিবেদন সে নতুন শব্দে, আচরণে বিমোহিত হয়;সক্রিয় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।
গুণীজন বলেন,ভালবাসা একধরণের শৈল্পিক কারুকাজ ;এরজন্য বুদ্ধি প্রয়োজন।আমরা জীবনাচাররে বহু
কাজ করি ; যেগুলো শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে।এই যেমন একজন
রিক্সার ড্রাইভার ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ঘরে ফিরে তখন বউয়ের জন্য কাগজ মুড়িয়ে একটা
চামুচা বা সিংড়া নিয়ে আসাও একধরণের শৈল্পিক আচরণ। সে তার অজান্তেই শিল্পের উপাদান
হয়।বায়েজিদ পানি এনে তার মাকে ঘুম থেকে জাগালে তা হতো সাধারণ আচরণ ;আর যখনি সে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে রইল তা হল আলোচনার বিষয়।এই ভিন্নতাই
শিল্প।এই জন্য আমরা পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে শিল্পিত জীবন চর্চা অনুসরণ করা
উচিত।এর মধ্যদিয়ে মানুষের একাকীত্বের দুর্বহ কষ্ট দূরীভূত হয়।
আমাদের পুরুষেরা সচরাচর পাকঘরে থালা বাসনে হাত দিইনা।কারণ,একে মেয়েলী ঘরানার অনিবার্য কাজ বলে মনে করি।কিন্তু এখানে যে পুরুষ হাত
দেন, গিন্নির এলোমেলো চুলগুলো ঘুচিয়ে দেবার চেষ্টা করেন
আর একটু মিষ্টি বকা খান;তিনি অন্যদের থেকে কিছুটা ভিন্ন;তিনিই শিল্পী।যদিও কেশগুচ্ছ নিয়ে ক্রীড়ারত ব্যক্তি ঘুচানো রন্ধনশালা
এলোমেলো করে দেয়,তবুও তার মধ্যে ভালবাসামিশ্রিত
একধরণের শৈল্পিক আচরণ খুঁজে পাওয়া যায়।গিন্নীসমাজের
এক্ষেত্রে ভিন্নমত থাকতেও পারে। সে যাক।রন্ধনে যেমন শিল্প আছে,ভোজনেও আছে।ভোজনে শিল্প না থাকলে তা হয় গলদকরণ। শিল্প বৃত্তের বাইরে
হলেও আইনের বাইরে নয়।
শিল্পী নিজের মতো করে নিজেরে প্রিয় জনের
কাছে উপস্থিত করে,নিজের ইচ্ছের সমুদ্রে ভালবাসার
শব্দগুলোকে রং-রেখায়,শব্দে সাজাতে বিভোর থাকে।নিজের শব্দকে সবার শব্দে রূপান্তরের প্রয়াসী হন।সার্বজনীন
সত্যের প্রকাশক হিসেবে আভির্ভূত হন ।নতুন সভ্যতা বিনির্মাণে নিউরণে বিস্ফোরণ
ঘটায়;দেশকালের সীমানা নিশ্চিহ্ন
হয়।এই অবিচ্ছিন্নতা শুধুমাত্র আরোপিত কাল্পনিক রেখার ক্ষেত্রে নয়;মানুষের মননে,মগজে সবখানে।আত্মগত এক
প্রত্যাশিত বন্ধনে শিল্পীরা বিশ্বব্যাপী এক
অবিচ্ছিন্ন চিন্তায় ঐক্যবদ্ধ।এরা মানবতার মুক্তি প্রত্যাশী। যেহেতু আমি কালে অন্তর্হিত সত্ত্বার স্বপ্নফেরি করা অভাজন,
আমি তাদের সাথেই অনুক্ষণ বিরাজিত। বন্ধনহীন সন্ধিতে
বিশ্বাসী এসব ব্যক্তিসত্ত্বাই যথার্থ শিল্পী। কারণ,এরা
একটু আলাদা,কিছুটা অন্যরকম
ভালবাসায় শিল্পের উপস্থিতির কারণে মানুষ শিল্পের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন
করে এবং শিল্পের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়।শিল্পের প্রতি ভালবাসা একটি জাতির
জীবনধারাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।কারণ,শিল্পের প্রতি
আগ্রহ এর স্রষ্টার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণ হয়।বাংলাদেশে শিল্প ও শিল্পী কখনো
যথার্থ মর্যাদা পায়নি।তার মানে এই যে আমরা জাতি হিসেবে এখনো শিল্পিত মননের অধিকারী
হতে পারিনি। বর্তমানে দলীয় লেবাসে ঢাকা, ময়ূরের পেখম
লাগানো গোষ্ঠীর সদস্যরাই শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে,প্রচার
পাচ্ছে।অন্যদিকে, অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ শিল্পী আর্থিক
সংকটে পড়ে শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন।প্রতিটি যুগে রাষ্ট্রই শিল্পীকে
লালন করেছে;লালন করেছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে।রাষ্ট্রকে
অমরত্বের আসনে নিয়ে যায় শিল্পী।বর্তমানে গ্রীসের অতীতের রণশক্তির গৌরব নেই,কিন্তু তার জ্ঞানের গৌরবে ভাটা পড়েনি।আগামীতেও তা অভ্যাহত থাকবে
। বাংলাদেশে অসম উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে এর অক্ষয় সত্ত্বা শিল্পীসমাজ চরম অবহেলার
শিকার হচ্ছে।
শিল্পী তার চিন্তা দিয়ে রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণ করেন ;আর এর কাঠামোগত রূপ দেন
রাষ্ট্রের আইন প্রণেতাগণ।কিন্তু আইন প্রণেতাগণ যদি শিল্প না বুঝেন রাষ্ট্রের
বিনির্মাণ কিভাবে সম্ভব হবে?
বর্তমানে
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যক্তি শিল্প বুঝেন না।ফলে তারা শিল্প
ও শিল্পীর লালনে অক্ষম।শিল্পী এক অপরাজেয় সত্ত্বার নাম।তারা দলে থেকেও দলের
ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন।শাসক শ্রেণি যদি এটা বুঝতে অক্ষম হন তাহলে তা সমূহ ক্ষতির
কারণ।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তা বুঝতেন;ফলে ভিন্ন মতের
অধিকারী হলেও তিনি কবি ফররূখ আহমেদ কিংবা কবি আল মাহমুদকে যথাযোগ্য সম্মান
প্রদর্শনে কার্পণ্য করেননি।বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে
চেষ্টা করছেন।কিন্তু যতটুকু মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে
তাঁর কর্মপরিধির বিস্তার সীমায়িত। সুযোগ
সন্ধানীদের ভাগবাটোয়ারার খেলায় অনেক প্রতিভাবান দূরে পড়ে গেছে।সত্য হচ্ছে:রাজনীতির
কূটচালে পড়ে জগৎবিখ্যাত শিল্পী সুলতানও তাঁর যথাযোগ্য সম্মান পাননি।যৌবনের যে সময়ে
তাঁর জাতিকে দেওয়ার সুযোগ ছিল, তিনি দেবার সুযোগ পাননি।রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে অবহেলায় পড়ে থাকা এসব
তাপসদের রাষ্ট্রকেই খুঁজে নিতে হবে।তাদের চিন্তা ও কর্মকে প্রকাশের সুযোগ করে দিতে
হবে।তবেই রাষ্টের ভীত মজবুত হবে।2/25/18
-------