প্রধান শিক্ষকের
আত্মকথা(পর্ব-২):নিয়োগ পাওয়ার সংগ্রাম
মন্ডল সাহেব উপজেলার
দলীয় প্রধানের নিকট গেলেন।সাথে আমিও গেলাম।তিনি
বললেন, নেতাজি, ইনাকে নিয়োগ দেব বলে দুই লক্ষ টাকা নিয়েছি।একে নিয়োগ দিতে হবে।
নেতা চোখ বন্ধ
করলেন।ভাবলেন।গভীর ভাবনা।তারপর বললেন,মানিক,সবুজ এরাতো কালাম নামে একজনকে নিয়োগ দেবার সুপারিশ নিয়ে এসেছিল।তাদেরকে
আমি কী বলব?একেবারেই স্বাভাবিক আলোচনা।
মন্ডল বলল, কালামকে আপনি
বোধহয় চেনেন।গালকাটা নৈজ্জার বড় ছেলে।রাজাকার ; আস্ত একটা
হারামির বাচ্চা।
নেতা গম্ভীর।তারপর বললেন, এভাবে
বলোনা।তাঁর সবগুলো ছেলে মেয়ে শিক্ষিত।এখন যাও।আচ্ছা দেখি কী করা যায়।
আসার সময় আমি টুপ করে নেতার কদমবুসি করলাম।তিনি বললেন,জহির
এখন সবকিছুই হাতে থেকেও নেই।যাক,তবুও আশা রাখ।
আমার নেতা মণ্ডল খুব
চালাক।সে মানিক আর সবুজকে বুঝাল।টিপু সাহেব আমাদের দলের লোক।টাকা কম দিবে বা বেশি
দিবেন এটি মূল বিবেচ্চ্য নয়।দল ক্ষমতা হারালেও এর কাছে আমাদের সম্মান থাকবে।তিনি
অন্ততপক্ষে বসতে একটা চেয়ার দিবেন।আবার আমাদেরকে চা নাস্তার টাকাও দিবেন।একেবারে
কম নয়।তোমাদের জন্য একলক্ষ দিবেন।আর কালাম মিয়া
রেজাকারের বাচ্চা। তারজন্য তোমরা নেতার কাছে গিয়েছ।এটা কী ঠিক হল? সে দশ লক্ষ টাকা দিলেও তার কাজ করা ঠিক হবেনা।অবশেষে আমার দল ভারী হল।
বিদ্যালয়ের সভাপতির পরামর্শ
অনুযায়ী উপজেলা শিক্ষা অফিস এবং ডিজি প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করলাম।তিনিও যথা সম্ভব
সমর্থন জানালেন।ডিজি প্রতিনিধি নীতিবান ব্যক্তি। তিনি দুর্নীতি করতে ইচ্চুক
নন।কাজটি জটিল হয়ে গেল।আবার আমি দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করলাম। উপজেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী
নেতার দ্বারস্থ হলাম।সাথে গেল দলের স্থানীয় তিনজন।অত:পর নেতা ডিজি প্রতিনিধিকে
বললেন।তিনি নমনীয় হলেন।তিনি প্রশ্নের ধারণা দিলেন।আমিও নীরবে একটি খাম
দিলাম।একলক্ষ টাকা।এখন আমি নির্ভার। যথাসময়ে নিয়োগ পরীক্ষা হল।আমি লিখিত পরীক্ষায়
পঞ্চম হলাম।তবুও আমি সাহস হারালামনা।মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেলাম।অবশষে আমিই প্রথম হলাম।
নিয়োগ পত্র
গ্রহণ
স্কুল কমিটি মিটিং করার
সিদ্ধান্ত নিল।তার পূর্বে আমার ডাক পড়ল।কমিটির সভাপতি এবং আরো দুজন সদস্য
থাকলেন।আসর নামাজের পরে মসজিদে বসলাম।সভাপতি সাহেবই এই ব্যবস্থা করলেন। তাদের একজন
কথা শুরু করলেন।তিনি বললেন,আমাদের পূর্বের প্রধান শিক্ষক
স্কুলের হিসেবে বড় ধরণের গরমিল করেছেন।এর পরিমাণ প্রায় দুই লক্ষ টাকা।এখন আপনি এই টাকা দিতে হবে;তা না হলে আপনাকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবেনা।কারণ,মন্ত্রনালয়ের অডিটে ধরা খেলে স্কুলের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে।আমার মাথা
ঘুরে উঠল।গাঁদিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল।কিন্তু আমি স্থিরপদ রইলাম।বললাম, ঠিক আছে আমি রাজি।তবে এমপিও পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ করলাম। সভাপতি
সাহেব বললেন,অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতে হবে।ইতোমধ্যে, আড়াই তিন লাখ খরচ হল।পেছনে ফেরার পথ নেই।
যথারীতি অনুষ্ঠান করে নিয়োগ
পত্র দেয়া হল।কমিটির সদস্যবৃন্দ আমার উচ্চ যোগ্যতার প্রশংসা করলেন। উপস্থিত
শিক্ষকবৃন্দ নির্বাক এবং অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।সিনিয়র শিক্ষকগণ ইঙ্গিতময় দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চাইলেন।আমি এসব বুঝতে চাইলাম না।কমিটির সকল সদস্য আমাকে সর্বাত্মক
সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং উপস্থিত শিক্ষকদেরকে সহযোগিতা করার অনুরোধ
জানান।সভায় উপস্থিত কলিমুল্লা স্যার স্বচ্চ নিয়োগ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান
শিক্ষকের সাফল্য কামনা করেন।তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উন্নত মানসিকতার বিষয়টি
উল্লেখ করেন এবং যৌক্তিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।বাদবাকি শিক্ষকগণের কেউ কোন কথা
বলতে চাইলেন না।
শিক্ষকদের
সাথে প্রথম বৈঠক
আমি শিক্ষকদের সাথে প্রথম
বৈঠক আহবান করলাম।মূলতঃ পরিচিত হওয়ার জন্যই এই
আয়োজন।।কিভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করব তা নিয়ে তাদের অভিমত চাইলাম।কেউ কিছু বলতে চাইল
না।বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দু'একজন বলল,আপনি বিধি অনুযায়ী চালাবেন। সমস্যা হলো, স্কুল
পরিচালনার বিধিবিধান মাথায় নেই;ঐসব সকলই বইয়ে
আছে।দীর্ঘদিন আমি নিজেও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি।সহকারি শিক্ষকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের হয়রানির শেষ নেই।বলতে দ্বিধা নেই;আমি নিজেও সেই দলে ছিলাম।দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষকের জন্ম নিয়ে কথা
বলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।আবার নীতিবাদী প্রধান শিক্ষকও ফাঁকিবাজ শিক্ষকের
সমালোচনার পাত্র হন। আমি তাঁদেরকে বললাম, আগে কী হয়েছে
বা কিভাবে চলেছে তা আমার জানার দরকার নেই।এখন থেকে নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যালয়
চলবে।শিক্ষকগণ শুনলেন।কিন্তু নিরুত্তর রইলেন।একধরণের থমথমে ভাব।একজনতো বলেই ফেললেন,স্যার নিয়মে কি কিছু হয় - না হচ্ছে? পরিবারের
যে ছেলেটা বেয়াদপ টাইপের তাকে সবাই ভয় পায়।নেতা হয় সে।তার বউও বাবা মায়ের
আদরের।ভদ্র ও শান্ত ছেলেরা অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
আমি নিজেও শিকার করে নিলাম; কথাটি
সত্য।উপস্থিত শিক্ষকগণও মাথা নাড়লেন।
কলিমুলা সাহেব বললেন,আজকাল
সমাজের নেতা কারা হচ্ছে দেখুন।ভেঙ্গে বলার দরকার কী?ভাল করে
বাংলা বলতে পারেনা।তারা নেতা।
আরে কী যে বলেন ,আমাদের
শিক্ষকদের ক’জন শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে সমর্থ?নাজমুল আহসান সাহেব বললেন।
সবাই নীরব হয়ে গেল।এজেন্ডাবিহীন আলোচনা আর বাড়ল
না।আমি বললাম,ক্লাস রুটিন যেভাবে চলছে- চলুক।দশম
শ্রেণির গণিত আমি নেব।এখন বছরের প্রায় শেষ।ইনশাল্লাহ আগামী বছর এই বিষয়ে যৌক্তিক
সিদ্ধান্ত নেব।আপনারা কী বলেন?
চার পাঁচ জন শিক্ষক সমস্বরে বললেন,ঠিক
আছে স্যার।অতঃপর আমি বললাম,আমরা সবাই একটি পরিবারের মত।এটি
সকলের মাথায় রাখতে হবে।এখানে আমার এক সপ্তাহ পূর্ণ হল।আমি যা দেখলাম,তাতে মনে হলঃআপনারা বিদ্যালয়ে আগমন প্রস্থানের বিষয়ে সিরিয়াস নয়।আপনাদের
জ্ঞান দেবনা।তবে ইমাম গাজ্জ্বালী(রঃ) সাহেব তাঁর একটি বইয়ে লিখেছেন,কর্মস্থলে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া একটি অভ্যাসগত কাজ।আসুন, আমরা সকলেই এই অভ্যাস গড়ে তুলি।অন্ধ লোকের সুন্দরী স্ত্রী মূল্যহীন।আমি
অন্ধ নই।আমি আমার শিক্ষকদের যথার্থ মূল্য দেব।
তারপরেও মনে হল,তারা অনেক কিছু জানে।জানুক;আমার কিছুই যায় আসে
না।বেয়াড়াদের কিভাবে বাধ্য করতে হয় তা আমি জানি।আমি হাঁসি হাঁসি মুখে সকলের মুখের
দিকে তাকালাম।তারপর সভা সমাপ্তি ঘোষণা করলাম।আমার অনেক কাজ আছে।
এমপিও এর জন্য
কাগজপত্র প্রেরণ
এমপিও-এর কাগজপত্র সঠিকভাবে
প্রেরণ এক মহা কর্মযজ্ঞ। দুনিয়ার সব নিয়ম কানুন এখানে একত্রিত হয়েছে।উপজেলা শিক্ষা
অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস, ডিডি
অফিস এবং সর্বশেষে ডিজি অফিস সব স্থানেই(?) নজরানাসহ সশরীরে উপস্থিত হতে হয়।সর্বপ্রথম উপজেলা
শিক্ষা কর্মকর্তার অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করাতে হয়।আমিও যথারীতি
গেলাম।শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষর করবেন না।কারণ,এরজন্য তাকে
ঘুষ দেওয়া হয়নি।অগত্যা ঘুষ দিতেই হল;না হলে কাগজপত্রে ভুল
থাকবে ;সময়মত জেলা অফিসে কাগজপত্র পাঠানো অসম্ভব
হবে।জেলা অফিসে অলিখিত নিয়ম
আছে:কুড়ি হাজার দিতে হয়।আমাকেও দিতে হল।সবাই বলে, জলে
থেকে কুমিরের সাথে বাড়াবাড়ি নিরাপদ নয়।ডিজি অফিস এখন দুর্নীতিমুক্ত!সবখানে সিসি ক্যামরা লাগানো।যা দিতে হয় তা বাইরেই
সম্পন্ন হয়।সেখানে ত্রিশ হাজারে মুক্তি মিলল।তবে কম লেগেছে।শহরে আর গ্রামে হারে ভিন্নতা আছে।দুই মাসের পরেই
এমপিও এল।
সমমনা বন্ধুরা বলেন,এটাতো ব্যবসায় বিনিয়োগ। আমাকেও মেনে নিতে হল।এছাড়া উপায় কী!আবার অনেকে
বলেন,শালারা ঘুষখোরেরা সব ফকিন্নির পুত্র আর নিলজ্জ!তারা অজুহাত দাঁড়া করায় ,আমরা
অতিরিক্ত কাজ করি।তাই মানুষ দেয়।সব মিথ্যা।“মানুষ
জানে সে কী করে;সে শুধু আজুহাতের অবতারণা করে।” তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে।আমি তখন নীরব শ্রোতা।
-----
প্রধান শিক্ষকের
আত্মকথা(পর্ব-২):নিয়োগ পাওয়ার সংগ্রাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন