শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

আমার দেখা চার দশকের সমাজ পরিবর্তন:প্রেক্ষিত কোম্পানিগঞ্জ



আমার দেখা চার দশকের সমাজ পরিবর্তন:প্রেক্ষিত কোম্পানিগঞ্জ


লেখাটি বিশেষ করে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার চার দশকের সমাজ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে।আপনারা হয়ত এর মধ্যে বাংলার অপরাপর অংশকেও খুঁজে পাবেন।বিগত চার দশকে বাংলাদেশে বিভিন্নমুখী পরিবর্তন ঘটেছে।সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।বর্তমানেও খুবই দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এই পরিবর্তন সবক্ষেত্রে যে প্রত্যাশিত মাত্রায় হচ্ছে তা নয়।সংস্কৃতির অসম মিথষ্ক্রিয়া সমাজ কাঠামোকে অস্থির অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।আমরা কিভাবে দ্রুত ধাবমান সমাজে বেড়ে উঠেছি,কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছি তা অনেক সময় ভাববার সময় পাইনা।আমরা কিরকম অবস্থার মধ্যদিয়ে অগ্রসর হচ্ছি তা একটু দেখি।
          বিগত চল্লিশ বছরে কোম্পানিগঞ্জের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন সংঘটন ও ব্যক্তি সমাজ পরিবর্তনে এ ভূমিকা রাখে।

শিশুর সকাল:

আশির দশকের বাংলাদেশের শিশুর দিনযাপন :কাঁধে লুঙ্গি ঝুলিয়ে কাদামাখা শরীর নিয়ে হাঁটছে,মাঠে দৌঁড়ছে এরকম শিশু কিশোরদের আশির দশকের শুরুতে প্রায় রাস্তাঘাটে দেখা যেত।আমাদের শৈশবের দিকে তাকালে যে চিত্র ভেসে ওঠে তা আজকের দিনের শিশুদের কাছে অকল্পনীয় মনে হবে।বর্তমানে সাধারণ গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণ স্বরূপে প্রকাশিত ঐ জীবনের অন্তর্ধান ঘটেছে।আমি আমার শৈশবের দিকে তাকালে দেখি আমারা চিন্তায় ছিলাম অধিকতর মানবিক এবং কর্মে ছিলাম সহযোগী।
    ১৯৭৮ সালে গ্রামের একটি শিশুর দিন স্বাভাবিকভাবে  শুরু হত মক্তবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।আমরা অনেক কিছু পেয়েছি;অনেক হারিয়াছি।কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যেই রয়ে যাচ্ছে  অনুসরণীয় জীবনের অনেক কিছু।জীবনের বাঁকে বাঁকে বহু  পরিবর্তন ঘটেছে,ঘটেছে বিনির্মাণ।এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, 
জমিদার শ্রেণি ব্যতীত বাঙালির শিক্ষা ও রাজনৈতিক দিকে সার্বজনীন পরিবর্তন ঘটেনি।কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের উত্থান বাংলার অপরাপর অংশে পরিবর্তন আনয়নে প্রত্যাশিত কিছুই করেনি।তবে প্রথম মহাযুদ্ধ বাঙালির সমৃদ্ধ উত্তরকাল সৃজনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।আমার যতটুকু মনে হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধ বিশ্বের অন্য অঞ্চলের মত বাঙালির মননে আর চিন্তায় পরিবর্তন এনেছিল;এটি নিজ স্বাধিকার, আত্মসচেতনতা এবং সাহসী আগামী নির্মানে ভেতরে ভেতরে প্রবাহমান ছিল।বিশেষ করে এযুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক বাঙালি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।  যেসব পরিবারের সদস্য প্রথম মহাযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল অথবা আধুনিক শিক্ষা অর্জনে সমর্থ হয়েছিল, তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনধারাতে নতুনত্ব এনেছিল।সক্রিয় মিথস্ক্রিয়ারদ্বারা এই প্রজন্মই সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাদের সন্তানদের মাধ্যমে তা তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম বিস্তার ঘটছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিনগুলো:

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির দিনটা আমার মনে আছে।স্যার আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন।অত:পর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতিতে একটা ঘটনা হচ্ছে হাসিনার বিয়ে।সে আমাদের সতীর্থ ছিল।তার রোল ছিল এক।ভাল এক্কা-দোক্কা খেলতো। সকলকে সহজেই হারিয়ে ফেলতো।হঠাৎ একদিন শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।হাসিনার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময় ছিল আনন্দঘন।কারণ পড়া-লেখার চাপ ছিলনা।স্কুল ছুটির পরে ইচ্ছেমত খেলা যেত।  চারজন শিক্ষকের তিনজন ছিলেন মৌলভী এবং একজন ছিলেন হিন্দু।মৌলভী স্যারদের বেতের আঘাত ছিল ভয়ানক।তবে তাঁরা পড়ার জন্য মারতেননা।অন্যায় কাজের জন্য শাস্তি দিতেন।শুধুমাত্র বাবুস্যার পিটাতেননা।তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে গণিত এবং ইংরেজি পড়াতেন। তিনি প্রায় ছয় ফুট লম্বা ছিলেন।তাঁর হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর।সকলে তাঁকে ভালবাসতো।আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আব্বা   একবারমাত্র  বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন।সেদিন  আমি  খুব খুশি হয়েছিলাম।  আমাদের বাবুস্যারও খুব খুশি হয়েছিলেন।সেসময়ে শিশুদের পড়া নিয়ে পিতামাতার মাথাব্যথা ছিলনা।একটি বিদ্যালয়েও নির্দিষ্ট পোশাক  ছিলনা।মেয়েদের অনেকে শাড়ি পরে স্কুলে আসত।ছাত্ররা লুঙ্গি পড়ে আসত।।আমরা স্কুলের ঘণ্টা শুনে স্কুলের দিকে দৌড় দিতাম।ছাত্রদের সকলেই লুঙ্গি পড়ত।   বিদ্যালয়ে যাচ্ছে -এই যা।
বর্তমানে সন্তানের শিক্ষা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা লক্ষণীয়। দরিদ্র বা ধনী সকলেই সন্তানের শিক্ষাদানে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।সরকারও শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে।শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সাথে অভিভাবকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সৃষ্টির প্রয়াসে পিটিএ কমিটি গঠন করা হয়েছে।মা সমাবেশ,অভিভাবক সমাবেশসহ বিভিন্ন রকম সভা সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে।মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে অভিভাবকদের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সুনির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে।

আমাদের অবসর এবং খেলাধুলা :

আমাদের সমবয়সী এলাকার ছেলেরা খেলাধুলা করত।আমরা হাডুডু,বোচিচি,  রেডি,লুকোচুরি, বো-জামাই,পয়সাখেলা  খেলতাম।আবার কখনো চোর-ডাণ্ডা খেলতাম। তবে চোর-ডান্ডা খেললে এলাকার মুরুব্বিরা নিষেধ করতো। ফুটবল গ্রাম এলাকায়  খুব কমই খেলা হত।তবে স্কুলে ফুটবল খেলা হত।স্কুল সন্নিহিত এলাকার শিক্ষার্থীরা ফুটবল খেলতো। আশির দশকের  শুরুতে বামনী  বাজারে দুটো ক্লাব  এবং একটি লাইব্রেরী গড়ে উঠে।    ক্লাব  দু'টো হলো আবহানী ও মোহামেডান।এরা ফুটবলকে জনপ্রিয় করার পেছনে ভূমিকা রাখেন।আবহানী ক্লাবের  আবু তাহের দুলাল এখনও খেলাধুলা নিয়ে আছেন। এই এই সময়ে বাংলাদেশে ফুটবল খুব জনপ্রিয় খেলা ছিল। 
           আমাদের বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল মাচ্ছাধোনা খাল;তার লাগোয়া বিশাল চর।রাখলের সাথে মাঝে মাঝেমধ্যে চরে যেতাম।রাখালের বাঁশী বাজানো সেখানে প্রথম দেখি।এই কারণে,উত্তর কৈশরে বধির তাজুর কাছে বাঁশি শেখার তালিম নিয়েছিলাম।এই খালকে শংকর বংশী খালও বলা হয়।একসময় এই খালে প্রচুর মাছ    পাওয়া যেত    আমাদের সমাজের বেশিরভাগ ছেলে পুলে স্কুলে যেতো না।আমার সমবয়সী  একজনও স্কুলে যেতো না।     
মাছধরাতে একধনের নেশা আছে।এই নেশার কারণে একবার দক্ষিণের চরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।মুনাফ নামে এক যুবক আমদের বাটিতে কাজ করতো। এক ভাদ্রমাসের অমাবস্যার সন্ধ্যায়  আমরা চারজন সেখানে হাজির হলাম।আমার বয়স ছিল মাত্র বারো।একধরণের উত্তেজনা বোধ করছিলাম।আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আট দশ কিলোমিটার দূরে জায়গাটি।মানুষ ষোল নম্বর স্লুইজ বলে চিনতো। রাত দশটায় জোয়ার আসবে তারপর আমরা জাল মারবো। বাটা চিংড়ি আর চিরিং মাছ আসবে।কিন্তু আটটায় আমার ঘুম পেল,খিদে অনুভব করলাম।মুনাফভাই সমস্যায় পড়লেন। শেষে পাশের একটা ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে গেলেন।মাঝবয়সী এক মহিলা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ালো।পরে ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে অল্প কয়েকটা মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা আর পুকুরে দীর্ঘসময় সাঁতার কাটা ছিল সাধারণ বিষয়।অন্যের গাছের ডাব খাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।শীতের রাতে খেজুররসের পায়েস রান্নার মজাই ছিল আলাদা।আমাদের সমবয়সী ছেলেরা প্রায় প্রতি রাতেই রস চুরির কাজটি করতো। তবে এ ধরনের চুরির জন্য কেউ অপরাধী হতো না।গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিগণও এধরণের কাজকে স্বাভাবিক বলেই স্বীকৃতি দিতেন। গ্রামের বুড়োরাও এজন্য ছেলেদেরকে বকাবকি করতো না।

আমরা সংসারের টুকিটাকি কাজকর্ম করতাম। দোকানে ধান ভাংতাম।চাল বিক্রি করতাম।একসের চাউলের দাম ছিল ৪টাকা ৫০পয়সা।এটা ১৯৮০ সালের কথা।

বামনীর প্রগতির দল:

শৈশবে আমদের টিভি দেখার সুযোগ হতো না।কারণ, আমাদের গ্রাম তখনও বিদ্যুতায়িত হয়নি। ২০০০সালের দিকে আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসে।আমরা অনেক সময়  গ্রামের বাজারে, দোকানে  যেতাম;তারা ব্যাটারির সাহায্যে টেলিভিশন চালাতো।            টেলিভিশনে   সিনেমা দেখতে যেতাম যা প্রতি সপ্তাহে একবার দেয়া হত।এটি সন্ধ্যায় আটটার সংবাদের পরে  প্রচারিত হত;শেষ হতো রাত ১২:০০টায়।প্রগতি গ্রন্থাগারে একদল প্রগতিশীল যুবক জমায়েত হত।আমরা প্রায় এখানে সিনেমা দেখতে যেতাম।বই পড়ার প্রতি এই সময়ে আমার আগ্রহ পাকাপোক্ত হয়।বর্তমানে প্রগতি গ্রন্থাগার বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত দেশের অন্যতম সেরা লাইব্রেরি।আশির দশকে আমাদের সমবয়সী  শিক্ষার্থীরা প্রচুর বই পড়তো এবং প্রগতির দল ছিল এর পুরোধা।এই প্রগতির দলের প্রায় প্রতিটি সদস্য পরিচ্ছন্ন মননের অধিকারী ছিল।পরবর্তিতে এদের প্রত্যেকেই কর্মজীবনে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।    পরবর্তী কালে আমার  বই পড়ার নেশা আর কেনার অভ্যাসের জন্য প্রগতির দলই দায়ী।এরা প্রতি বছর জাতীয় দিবস সমূহ সাড়ম্বরে পালন করতো ;দেয়ালিকা প্রকাশ করতো। বর্তমানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি শিশুর মানবিক বিকাশের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য তেমন কাজ করছে না।এখন সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগ জাতীয় মেধা অন্বেষণ ও অন্যান্য নামে   সরকারি  কর্মকর্তাদের নির্দশে পরিচালিত হচ্ছে।ফলে সম্ভাবনাময় অনেক শিশু কিশোর সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ সকল অনানুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্মে প্রশাসনিক হস্থক্ষেপ ও তদারকি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।বর্তমানে প্রগতির দলের লাইব্রেরী পাহারা দিয়েই সময় কাটে।অনেকে মনে করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)-এর রাজনৈতিক সক্রিয়তায় ব্যর্থতার কারণে এগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়;কারণ, এরা সকলেই জাসদ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল।এখন শিশু কিশোরেরা বই নিয়ে সময় কাটাতে অনভ্যস্ত। আজকাল জ্ঞানসাধনা ফেসবুকেই বন্দী হয়ে গ্যাছে।

বর্তমানে শহুরে শিশুর আউটডোরে খেলাধুলোর একেবারেই সীমিত। বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের পরিধি কাগজে কলমে বহু বিস্তৃত ;কিন্তু বাস্তবে সীমিত।অভিভাবকগণও সন্তানকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে;যার মানে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক জ্ঞান অর্জনকেই বুঝাচ্ছে।ছাত্র-ছাত্রীরা ভাল পাশ দিয়ে চাকুরী করবে - এটি বেশির ভাগ অভিভাবকের একান্ত চাওয়া।
বর্তমানে প্রায় প্রতিটি পরিবারে টিভিসেট রয়েছে।
বর্তমানে প্রগতির দলের অতীতের মত কর্মকাণ্ড নেই। নতুন পাঠক শ্রেণিও নেই। নতুন প্রজন্ম রাজনীতির অন্ধকূপে নতুন প্রজন্ম বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।  তারা বই পড়ে না;তারা গ্রন্থগারের  বৈকালিক আড্ডায় জমায়েত হয়না; তারা ক্ষমতা আর টাকার নেশায় আসক্ত হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে।
 প্রগতির দলে যেসকল যুবক সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন;শহীদ মোজাম্মেল হক কাঞ্চন, আনিছুল হক,মোমিন বাহার,আনসার উল্যা(সাবেক চেয়ারম্যান)  ইকবাল বাহার চৌধুরী(বর্তমান চেয়ারম্যান) , মোকাররম বিল্লাহ,মাস্টার মো:মোস্তফা,কামাল উদ্দিন, হেদায়েত উল্যা ,এয়ার হোসেন, ব্যাংকার হরলাল বাবু,মোমিন কাকা,সিম্যান রুহুল আমিন,মরহুম গোলাম কিবরিয়া,নূরুল আফসার মিয়া, অধ্যক্ষ মজনু মিয়া আরো অনেকে।ঐতিয্যবাহী বামনীতে এরাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছিলেন।এরাই প্রথম সার্বজনীন দৃষ্টি নিয়ে কোম্পানিগঞ্জে সর্বপ্রথম কেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।প্রগতি কিন্ডারগার্টেন* নামে এখনও এটি চলমান আছে।দীর্ঘদিন ধরে এরা শহীদ কাঞ্চন স্মৃতি বৃত্তি পরিচালনা করেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও এরা বরাবর সক্রিয় আছে।এদের মধ্যে নুরুল আফসার মিয়া বিভিন্ন প্রকাশনার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং সুনামও কুড়িয়েছেন।বিশেষ করে যুগান্তর প্রন্থাগার,প্রগতি প্রন্থাগার ,বামনী আছিরিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বার্ষিকী সম্পাদনা করে তিনি অভিনন্দিত হয়েছেন।
*বর্তমানে প্রগতি ইন্সটিটিউট

হাইস্কুলের দিনগুলো

আমি  ১৯৭৯ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই।প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রহমান স্যার।তিনি প্রশংসাপত্র দিলেন। আমাদের সকল ছাত্রের  জন্মতারিখ শুরু হল এক.এক দিয়ে। আমার যমজ একক্লাস  নিচে ছিল।সে পাস করলো তার জম্মতারিখ হল একবছর পরে। ঐদিনগুলোতে  শিক্ষার্থীর জন্মরারিখ ঠিক করতেন প্রধান শিক্ষক। ফলে এক ঘন্টার ব্যবধানে জন্ম হলেও আমরা দুইযমজ এক বছরের ছোট-বড় হয়ে গেলাম।
আমি একা একা হাইস্কুলে  যাওয়া শুরু করলাম।আমার হাইস্কুলের  জীবন      ইস্কুলের জীবন বিশেষ কোন ঘটনা ছিল বলে মনে হয়না।দু'একজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। একজন ছিলেন বিকম বাবু স্যার।তিনি পাজামা পাঞ্জাবি পরে আসতেন।বেশ ফিটফাট চলতেন।তিনি   নবম শ্রেণিতে সাধারণ গণিত করাতেন। তিনি মুখে মুখে গণিত বুঝিয়ে দিতেন। ছাত্ররা খুব সহজে বুঝত।তিনি ইসলাম ধর্ম ও আরবিও পড়তে পারতেন।তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছিলেন।আমরা আমাদের শিক্ষকদের খুব ভয় পেতাম।দু'তিন জন ছাড়া সকল শিক্ষক ছাত্রদের খুব পিটাতেন।বাড়ির কাজ না করলে মার অনিবার্য ছিল।আমাদের অনেক সতীর্থ মারের ভয়ে স্কুল আসা বন্ধ করে দেয়।তখনকারদিনে এটাই স্বাভাবিক ছিল। ফলে আমি একা হয়ে গেলাম।
                           শ্রেণিতে সর্ব কনিষ্ঠ শিক্ষার্থী ছিলাম আমি।এগারটায় ক্লাস শুরু হত।আমরা বাড়ি থেকে আটটায় বের হতাম।বলা যায় বিদ্যালয়েয় পথ দুর্গম ছিল।বাড়িথেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব ছিল চার কিলো মিটার।গাড়ি ঘোড়া ছিলনা।পাঁয়ে হাটা ছিল যাতায়াতের প্রধান উপায়। স্কুল ছুটি হত পাঁছটায়।  আমাদের সতীর্থদের মধ্যে অধিকাংশের দিনে একটাকা খরচ করা সম্ভব হতো না। দুপুরে একঘন্টার  বিরতি দেয়া হত।

আমরা চার আনার মুড়ি আর চার আনার চানাচুর খেতাম।তারপর পানি খেতাম। এটি ছিল স্বাভাবিক।       শিশুরা দুপুরে উপোষ থাকবে এটাই ছিল তখনকার সময়ের মানুষের বিশ্বাস। ।বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত।ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যেতাম।এভাবেই যাচ্ছিল আমার বিদ্যালয়ের দিনগুলো।

আমি ১৯৮৪ সালে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।টেস্ট পরীক্ষায় অধিকাংশই  দু'তিন বিষয়ে ফেল। তবে ভয়ের কিছু নেই।মিলন বাবু স্যার বললেন,ইংরেজিতে টেস্টে  ২৫ পেলে ফাইনালে ৫০ পাবে।কারণ,স্যার সবসময় অর্ধেক নাম্বার দিতেন।তখনকার দিনে এটিই নিয়ম ছিল।
 এস এস সি   সেন্টার পরীক্ষায় প্রচুর নকল হতো।দেয়াল টপকিয়ে স্বজন ও বন্ধুবান্ধব নকল সরবারহে সাহায্য করতো। এসময় জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেছিলেন।তিনি জাতীয় ছাত্র সমাজ নামে নতুন ছাত্র সংঘটন গড়ে তুলেছিলেন।তখন তাদের খুব ক্ষমতা।শিক্ষকগণও তাদের কাছে খুব অসহায় ছিলেন।পরবর্তিতে ঐসকলবাজ ছাত্ররা এস এস সি পাশ করে এরশাদের ছাত্র সংঘটনে যোগ দেয় এবং এরা প্রায়ই অস্র নিয়ে কলেজে ঘোরা ফেরা করত।
তখন স্কুলে সিনিয়রদের খুব সম্মান করা হত।আমরা উপরের শ্রেণির ক্লাসের সামনে দিয়ে হাঁটতাম না। তখন স্কুলের নেতা নির্বাচন হত।এই জন্য ভোট হত না।শিক্ষকরাই নেতা কে হবে ঠিক করতেন।এইক্ষেত্রে যারা স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত থাকতো তাদেরকে নির্বাচন করা হতো।

রাস্তাঘাট নির্মাণ :

আশির দশকের শুরুতে জিয়াউর রহমান খাল কাটা কর্মসূচি চালু করে।নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করে।গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলে আসার পথ ১৯৮১ সালেই নির্মান করা হয়।এর আগে আমি বর্ষায় রাস্তার উপরে জাল দিয়ে ফাঁদ ফেলতাম এবং মাছ ধরতাম   নতুন রাস্তা নির্মিত হলে রিক্সা চলা শুরু হয়।আমাদের স্কুলে যাওয়াও নিয়মিত হয়।   ঝড়- বৃষ্টি হলে আমি  প্রায় স্কুলে যেতাম না।

বর্তমানে বসুরহাটের আশে পাশের প্রায় সবগুলো রাস্তাঘাট পাকা। সর্বত্র  ইঞ্জিল চালিত গাড়ির ছড়াছড়ি। রিক্সাতো আছেই।
১৯৮০ সালের দিকে বসুরহাট বাজার ছিল খুবই ছোট। পুরোবাজার ঘুরতে আধাঘণ্টাও লাগতো না।বাজারে বিদ্যুৎ ছিলনা।বাজারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শংকরবংশি খাল খুব চওড়া ছিল।বড় বড় নৌকো আসতো। খালের উপরে থাকা পুল কালভার্টগুলো ছিল ধনুকের মত বাঁকা।কারণ,ঐসকল ব্রিজের নিচে দিয়ে নৌকা চলাচল করতো।
বসুরহাট বাজার চল্লিশ বছরের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এখন এটি দ্বিতীয় স্তরের পৌরসভা।অনেক কর্মযজ্ঞ।বর্তমানে স্রোতস্বিনী শংকরবংশী মৃত।তার প্রবাহ বন্ধ।নৌকো আসেনা।পুরো খাল আবর্জনার ভাগাড়।তার দু'পাশ প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।জ্ঞানীরা বলেন,গেরস্তের পাকঘর দিয়ে তার রুচি বোঝা যায়;আর শহরের মানুষের রুচি বোঝা যায় শহরের রাস্তাঘাট দেখলে।কিন্তু প্যারিসের মানুষ বলে,শহরের নদীর অবস্থা দিয়ে শহরের মানুষের মনের সৌন্দর্যবোধ বিচার করা যায়।

আশেপাশের মানুষ:

আমাদের চারদিকে প্রচুর দরিদ্র মানুষ ছিল।আফিয়া ও সাফিয়া নামে দু'বোন ছিল যারা সারা বছর আমাদের বাড়িতে কাজ করতো। তারা দু'জন বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা ছিল।তারা ধুমপান করতো। আমার দেখা প্রথম নারী ধূমপায়ী। আমার মা-জেঠি লুকিয়ে লুকিয়ে জেঠার বিড়ি তাদেরকে      দিত।আমাদের অনেকগুলো গরু ছাগল ছিল।হাসেম,কাশেম আর কালামিয়া সারা বছর কাজ করতো। তারা খুব গরীব ছিল।মিলনের মা প্রতিদিন দুপুরে ভাতের মাড় নিতে আসতো।
স্বামী কর্তৃক বৌ পিটানো ছিল সাধারণ ঘটনা। আমাদের আশে পাশের বাড়িতে প্রায় বৌ পিটানোর ঘটনা ঘটতো। পিটানোর জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণও থাকতো না।যেমন তরকারিতে লবন কম হওয়া, ভাত রাঁধতে দেরি হওয়া,শাশুড়ির সাথে তর্ক করা,পুকুর ঘাটে দেরি করা হল এক একটা কারণ।মিলনের মা তো প্রায় পিটুনি খেত।ফকির আহম্মদের পিটাপিটির খবর সবাই জানতো। সে ছিল ঘর জামাই।এই বউ পেটানো যতটা না ছিল স্বভাবে তার চেয়ে বেশি ছিল অভাবে।
বর্তমানে বউ পেটানোর খবর খুব একটা শোনা যায়না। বরং ঐস্তরের পরিবারে ভাঙ্গনের সুরই বেশি।মামলা হচ্ছে অহরহ।দ্রুতগতিতে মানুষের  আয় বেড়েছে। এখন বউ বাচ্ছা নিয়ে বহু দম্পতি উপজেলার কেন্দ্রে বাসা ভাড়া করে থাকছে।আজকাল বহু পেশাজীবিকে বসুরহাটে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে   দেখা যায়।এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রবাসীর পরিবার,শিক্ষক অটো রাইচ মিলের শ্রমিক,রিক্সাচালক,সুইপার  কিংবা বাদাম বিক্রেতা। বর্তমানে বসুরহাটে প্রায় শাতাদিক রিক্সাজীবি আছেন যারা  স্থানীয় নয়।

ঘরবাড়ির অবস্থা:

আমাদের শৈশবে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িঘর ছিল কাঁচা।ছনের ছাউনি এবং বেড়া ছিল বাঁশ অথবা পাটকাঠির। ঘুমানোর জন্য ব্যবহার করা হত পাটিপাতার বিছানা এবং কাঁথা।অধিকাংশ পরিবারের লোকজন দিনে আনে দিনে খায় এমন ছিল।যাদের চাষের জমি বেশি ছিল তারা সারা বছরের খাবার সংরক্ষণ করতো। তবে এই রকম পরিবার খুব বেশি ছিলনা।কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় ভূমিহীন লোক কিছু ছিল কিন্তু গৃহহীন লোক  ছিলনা বললেই চলে।
বর্তমানে অধিকাংশ বাড়িতে পাকা ভবন নির্মিত হয়েছে।অনেকে শহরে ঘরভাড়া করে বসবাস করছে যা আগে কেউ চিন্তাই করতো না।

খাওয়া দাওয়া :

  এই সময়  অধিকাংশ পরিরারে পারিবারিক খামার ছিল।অন্ততপক্ষে দু'একটা গাভী এবং ক'য়েকটা মুরগি  লালন পালন করতো।প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।প্রচুর শাক সবজি পাওয়া যেত।প্রায়  কোন পরিবারেই সোফাসেট বা ডাইনিং টেবিল ছিল না।সকলেই পাটি বিছিয়ে খাওয়ার খেত।ঢেকিতে ধান ভাঙতো।মুসলিম পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে গরুর মাংশের সাথে মাস কলাইয়ের ডাল আর একটা সবজি দেয়া হত।সবজি হিসেবে কদুর তরকারি প্রাধান্য পেত।
বর্তমানে অধিকাংশ বাড়িঘরে সোফাসেট এবং ডাইনিং টেবিল আছে।পাটি পেতে খাওয়ার ঐতিহ্য লুপ্তপ্রায়।এখন শাকশবজি, মাছ,মাংশ সকল কিছু ব্যবসায়িক দৃষ্টি নিয়ে উৎপাদন করা হয়।অন্যদিকে বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠানে খাওয়ার মেনুতে বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়িয়েছে।অনেক বিয়েতে গরুর মাংস, খাসির মাংস, কবুতরের মাংস,মুরগি, চিংড়ি মাছ,রুই মাছ,ভর্তা,সবজি,দধি , কোমল পানীয় ইত্যাদি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:


বিগত চার দশকে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে।কোম্পানিগঞ্জ উপজেলাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বহু মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ-আমেরিকাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ রয়েছে।ফলে তাদের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন দিকে সমাজমানসে ব্যাপক উলট-পালট ঘটেছে।বিশেষকরে আশির দশকের শুরুতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।এসময় কোম্পানিগঞ্জে এসময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়।কবি জসীম উদ্দিন পাঠাগার সাংস্কৃতিক জগতে নেতৃত্ব দেয়।কিন্তু কিছুকাল পরেই এর অস্তিত্ব বিলীন হয়।এরা বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল, যা শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।     জেনারেল এরশাদের শাসনকালে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়।এরই মাঝে কোম্পানিগঞ্জ সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়,যাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস স্যার নেতৃত্ব দেন।
          আশির দশকের মাঝামাঝি কোম্পানিগঞ্জে লিটল ম্যাগাজিনের আদলে বেশকিছু পত্রিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। আফতাব আহমেদ বাচ্ছুর সম্পদনায় মাসিক পদক্ষেপ , আবু সুফিয়ানের সম্পাদনায় মাসিক উত্তরণ, মাকছুদের রহমান মানিকের সম্পদনায় মাসিক স্বরাজ এবং সেলিম কলির সম্পাদনায়ও মাঝে মাঝে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত । নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার হয়,কিন্তু এসময় নতুন কিছু উল্লেখযোগ্যভাবে হয়নি।এসময়ে আবদুল কাদের হাজারী নেতৃত্বে মাসিক নিম্নাঞ্চল প্রকাশিত হয়,কিন্তু তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।অন্যদিকে, একসময়ের মুজিব কলেজের ছাত্রনেতা দাগনভূঁইয়ার শহীদ উল্লার সম্পাদনায় মাসিক শুভেছা দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়েছিল;এটি কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায়ও গ্রাহক প্রিয়তা পেয়েছিল।
  বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্থানের কারণে বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা সক্রয় আছে।এর মধ্যে দুই সহযোদ্ধা এ এইচ এম  মান্নান মুন্না ও সোহরাব হোসেন বাবর-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত    নোয়াখালী টাইমস অন্যতম।
কোম্পানিগঞ্জে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রগামী দলে ছিল মুজিব মহাবিদ্যালয়। নাট্যকার ও অভিনেতা অধ্যক্ষ আবদুন নূর প্রায় প্রতি বছর বার্ষিক নাটক মঞ্চায়ন করতেন।এসময় তাঁর সংস্পর্শে বেশকিছু তরুণ-তরুণী সাংস্কৃতিক জগতে প্রবেশ করে।বর্তমানে তারা ব্যক্তিগতভাবে সাংস্কৃতিক কর্মী না হলেও অনেকে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন।এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন,সাবেক পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন। আইনজীবি আজিজুল হক অভিনীত চরিত্রের নাম বক্সী নামেই আজো পরিচিত।"লবণ সমুদ্র" নাটকের কথা অনেকেরই মনে থাকবে।  মুজিব কলেজ সরকারি হওয়ার পরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।

 ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোম্পানিগঞ্জে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়।এক্ষেত্রে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।বিজয় মেলা উদযাপন করার কারণে মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।একারণে গ্রাম পর্যায়েও সাংস্কৃতিক চর্চা চলে।কোম্পানিগঞ্জ সাংস্কৃতিক ফোরামের সভাপতি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ উদ্দিন বাবুল,  গ্রামীণ ব্যাংকের বসুরহাট শাখার ম্যানেজার বাবু মিহির ভট্ট,সমাজসেবা অফিসার আবুল হাসেম  রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ফিরোজ আলম ফিরোজ,আরজুমান্দ বিলকিস নিলুপা,মাইনুল এইচ সিরাজী, সোহেল মোহাম্মদ শরীফ, গোলাম কিবরিয়া বেলাল,হারুনর রশীদ শাহেদ,দানিয়েল শাহ, সবনুর নাহার মলি,নারী নেতৃ পারভীন আক্তার, ফরিদা ইয়াছমিন মুক্তা,শাহিদা আক্তার মুক্তা, শওকত আজিম    জাবেদ, নাজমা বেগম শিপা,করিমুল হক সাথী,আবদুল হালিম রকি,মানিক মজুমদার,বাবু মিলন দাস,সাইফুল্যাহ সোহাগ, জাফর  প্রমূখ।
এই গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সাহসী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছিল।তারা বেশকয়েকটা  মঞ্চ নাটক মঞ্চায়ন করেছিল।এই গোষ্ঠী বর্তমানেও সচল আছে।ফলে তাদের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।কচি কণ্ঠের আসর,সবুজ নারী সংঘ,  কোম্পানিগঞ্জ কবিতা পরিষদ,  উদীচী, খেলাঘর, মুক্তস্কাউট,মুক্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন, আল-আমিন শিল্পী গোষ্ঠী,মহিলা পরিষদ,   ব্যঞ্জনা খেলাঘর, কোম্পানিগঞ্জ নৃত্যকলা,বামনী সঙ্গীত বিদ্যালয়  এদের মধ্যে অন্যতম।অতি সম্প্রতি বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে কোম্পানিগঞ্জে "বিজ্ঞান ও সাহিত্য কেন্দ্র " প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে;যেখানে সভাপতি-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও গোলাম কিবরিয়া।  বর্তমানে কোম্পানিগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাঘরের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।ফলে তারা সক্রিয়ভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।প্রায় প্রতিটি জাতীয় দিবসে কবিতা পরিষদের আবৃত্তি, উদীচীসহ অপরাপর  সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পরিবেশনা থাকে। ।ইতোমধ্যে জুটন চন্দ্র সঙ্গীতে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে।সঙ্গীত লিখে সুনাম কুড়িয়েছে স্বশিক্ষিত মানুষ সিরাজুল ইসলাম। মাঝে মাঝে অজয় চক্রবর্তী গণ সঙ্গীত আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান লিখে বাহাবা পেয়ে থাকেন।তবে সকলের অগ্রজ রফিকুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কলম চালিয়ে যাচ্ছেন।তবে কোম্পানিগঞ্জের তরুণকণ্ঠ গোলাম সারোয়ার পেশায় একজন ব্যাংকার হলেও দু'হাতে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন।তিনি নিয়মিত জাতীয় দৈনিকে লেখার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে লিখে থাকেন।বর্তমানে নির্লিপ্ত মানুষ, সোহেল মোহাম্মদ শরীফ উত্তর কৈশরেই বেশ কিছু উপন্যাস লেখেছেন।অন্যদিকে ,নিভৃতচারী লেখক মাস্টার শাহ আলম নিয়মিত লেখালেখি করেন;যদিও আড্ডায় আসেন না।খুব সম্ভাবনাময় মাইনুল এইচ সিরাজী লেখার ইচ্ছে ধরে রেখেছেন;যদিও অনেকে তাঁকে ঈর্ষনীয় আসনে অনেকে কল্পনা করেছিল।  
 একসময়ে কোম্পানিগঞ্জে সাংস্কৃতিক জগতে নেতৃত্ব দিয়েছিল যোগিদিয়া।বর্তমানে এতে ভাটা পড়লেও  অষ্টপ্রহর কীর্তন যথারীতি প্রচলিত আছে।
          সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারায় বেশকিছু বিষয়ের নতুন সংযোজন ঘটেছে।এক্ষেত্রে বিদ্যালয় এবং কলেজ পর্যায়ে শুরু হয়েছে ক্লাস পার্টি,প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ।বর্তমানে মহিলা জামাতের উত্থান নবতর রাজনৈতিক ধারা;এটি মূলত জামাতে ইসলামীর একটি অঙ্গসংগঠন। এখানে জামাতের মহিলা শাখার কর্মী ও নেতা সপ্তাহে নির্দিষ্ট একদিন ধর্মীয় এবং দলীয় কর্ম-কৌশল নিয়ে আলোচনা করে।এদিন গ্রামের মহিলারা এবং শহরের দলীয় কর্মীরা একটি বাড়িতে জমায়েত হন।কোম্পানিগঞ্জে বসুরহাট পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জার নেতৃত্বে প্রায় প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবীর মিছিল বের হয়;যেখনে প্রচুর লোকের সমাবেশ ঘটে।তিনি অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর মিছিলেও অগ্রভাগে থাকেন।বর্তমানে, বৈশাখী উৎসবে প্রতিবছর সাড়ম্বরে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়।পৌর হলের লনে সার্বজনীন উৎসবের আমেজে পান্থা-ইলিশের আসর বসে;যেখানে নেতৃত্ব দেন পৌরসভার মেয়র।3/3/18
(অসমাপ্ত)  

     






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Printfriendly

Featured Post

জাতি নির্মাণে গল্পযোগ

  জাতি নির্মাণে গল্পযোগ   ১ ।   মানুষ সামাজিক জীব।তারা পরিবার গঠন করে।তারপর সে-ই পরিবার একটি গোষ্ঠীতে রুপান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে একাধিক গোষ...