শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২

আমার শিক্ষকগণ

 

আমার শিক্ষকগণ

বড়ই রাশভারী অধ্যাপক,আবু হামিদ লতিফ স্যার।প্রশ্ন করলেন,বাংলাদেশে শতকরা কতোজন শিক্ষিত।সহজ প্রশ্ন। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না।আমি উত্তর দিলাম,শতভাগ। শতভাগ লোক শিক্ষিত।সবাই আমার দিকে তাকালো।স্যার বললেন,আপনি সঠিক বলেছেন।একজন মানুষ স্বাক্ষর না হয়েও শিক্ষিত হতে পারেন।স্যার,উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার উপরে একটা কোর্স করাতেন।আমার দেখা অসাধারণ শিক্ষক।
শিক্ষা অর্জন করার পেছনে সার্টিফিকেট ভিত্তিক শিক্ষাকে আমরা বিশেষ বিবেচনায় রেখে থাকি।কিন্তু আমাদের জীবনব্যাপী শিক্ষার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সামন্যই অবদান থাকে।আমি সাঁতার শিখেছিলাম, সমবয়সী ফিরোজের থেকে;সে কৈশোরে মারা যায়।পুরুষের স্পেশাল কিছু জিনিস আছে,তা শিখিয়েছিলো দিনমুজুর ওসমান।প্রায় সমবয়সী। এখন নেই।
ব্যক্তিজীবনে সমস্যা এবং সংকটের মুখোমুখি হয়ে আমরা মৌলিক শিক্ষা অর্জন করে থাকি।শেখ সাদী বলেছেন,বোকাদেরকে শেখাবার উপায় হচ্ছেঃএদেরকে ব্যস্ত রাখা;এদেরকে ব্যস্ত রাখলে বোকামি করার সময় পায়না।বেয়াদপদের শেখাবার উপায় হচ্ছেঃমারের উপর রাখা এবং বুদ্ধিমানদের শেখাবার উপায় হচ্ছেঃসমস্যার মুখোমুখি রাখা,এতে তারা সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যাঁকে সবচেয়ে বেশি স্মরণে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন,বাবু ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার।ছ'ফুট উচ্চতার এই শিক্ষক আমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন।তাঁর শারীরিক উচ্চতার চেয়ে অধিকতর ছিলো মানবিক উচ্চতা।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর কুড়ি বছর পরে তাঁর সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করতে গিয়েছিলাম।ভালোলাগা যখন আত্মার সাথে একীভূত হয়ে যায়,তখন কেন ভালো লাগে তা শব্দে প্রকাশ করা যায় না।তবে পরবর্তী জীবনে এটুকু বুঝেছি যে,তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে আমাকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
মাধ্যমিক স্তরে আমি ছিলাম গুরুত্বহীন অস্তিত্ব।পরিবারের কেউ জানতেও চাইতো না, কী পড়ছি, কেমন পড়ছি।শুধুমাত্র কর্মব্যস্ত মা,পাশে আসতেন।বলতেন,পড়।এটুকু মনে বাজতো। কারণ,আমরা ছিলাম মায়ের বাধ্য ছেলে।মাধ্যমিকেও আমরা স্বপ্ন দেখিনি;বড় হওয়ার স্বপ্ন।এটা কেউ না কেউ দেখাতে হয়,আমাদের কেউ দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পেলাম। অধ্যাপক মোমিন উল্যাহ স্যার।আমার দেখা সেরা শিক্ষক।শাসনে,বচনে এবং শিক্ষণ শিখনে তাঁর সাথে তুলনা করার মতো কেউ নেই।তিনি জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন।কিন্তু প্রাইভেট পড়াতেন ইংরেজি।ইংরেজি শেখাবার সহজ কৌশল তিনি জানতেন এবং জানাতে সক্ষম ছিলেন।এখনও প্রতিটি মোনাজাতে তাঁর জন্য দোয়া করে থাকি।তাঁর কাছে আমার অশেষ ঋণ।
মানুষকে স্বপ্ন দেখানো শেখানো হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষাদান।এতে শিক্ষার্থী নিজ থেকেই এগিয়ে যায়।আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাস্তরে এটি নেই বললেই চলে।কারণ,হতাশাগ্রস্ত শিক্ষক স্বপ্ন দেখাবার সাহস রাখেনা।এটা আমি বুঝেছি।
এম এ ভর্তির আগেও আমার কথা বলায় শুদ্ধ উচ্চারণের উপায় ছিলো না।খাস নোয়াখালীর ভাষায় অধিকাংশ শিক্ষক পাঠ দিতেন।প্রাথমিকে শতভাগ শিক্ষক নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় পাঠদান করতেন,মাধ্যমিকে এটি কমে আসে।কিন্তু পরবর্তীতে এসে দেখলাম,তাঁদের অধিকাংশই শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতেন না।এই ঘাটতি অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যায়।আমাদের সন্মানিত আইন প্রণেতাদের সংসদের বিতর্ক শুনলে এটি বুঝতে পারবেন।আমারও উচ্চারণে ভুল ছিলো ভয়াবহ।আমার প্রতি সতীর্থদের করুণার দৃষ্টি দেখে ডঃনরেন বিশ্বাস স্যার বললেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেরাদের অন্যতম মুনির চৌধুরী এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী নোয়াখালীর মানুষ। সে শিখে নিবে।তারপরই উচ্চারণ শিখে নিই।সেটা ছিলো নীলখেত হাইস্কুলের করিডোরে।যতোদিন আমি কথা বলবো,ততদিনই নীলখেত স্কুলের করিডোর আর আলম খোরশেদকে মনে রাখতে হবে।
মানুষকে যে কতো ভালোভাবে ভালোবাসা যায় তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম,জনাব পেয়ারা মিয়ার(মুজিবুর রহমান চৌধুরী) থেকে।যিনি দাগনভূঁইয়ার কৃতিসন্তান।তাঁকে দেখে মনে হয়েছে মানুষের কল্যাণ কামনা করা এক ধরনের নেশা।যেটি আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমি সেই সকল শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি,যারা শিক্ষকতাকে উপভোগ করেন, যারা উপভোগ করেছিলেন, যারা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান; চরম সংকটেও সত্যকে ধারণ করেন।০৬/১০/২০২১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Printfriendly

Featured Post

জাতি নির্মাণে গল্পযোগ

  জাতি নির্মাণে গল্পযোগ   ১ ।   মানুষ সামাজিক জীব।তারা পরিবার গঠন করে।তারপর সে-ই পরিবার একটি গোষ্ঠীতে রুপান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে একাধিক গোষ...