বাংলাদেশের সামাজিক বিচার ব্যবস্থার স্বরূপ
একটা জাতির সামাজিক বিচার ব্যবস্থা
তার অন্তর্গত সৌন্দর্যের নির্ণায়ক।সামাজিক সুবিচার সমাজের ঐক্যের জন্য অপরিহার্য শর্ত।
একটা সমাজ কতটুকু এগুলো বা পেছালো তা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা দিয়ে সহজেই বোঝা যায়।এইক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন অবস্থানে আছে আমরা তা বুঝতে চেষ্টা করবো।
সমাজের বিচারক:
স্বাধীনতার পরে বা আশির দশকেও আমরা দেখেছি যে সমাজের বিভিন্ন ছোটখাটো সমস্যা সমাজের মোড়লেরাই সমাধান করতেন।তারা অসমর্থ
হলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার সমাধানের দায়িত্ব নিতেন।এইক্ষেত্রে মসজিদের
ইমাম ও স্থানীয় শিক্ষকও সাহায্য করতেন।
বর্তমানে সমাজে বিচারক হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা মূলতঃ ক্ষমতাসীন
দলের স্থানীয় নেতা এবং কর্মী।
বিচারের বিষয়ঃ
মারামারি, জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ, বিয়ে
সংক্রান্ত সমস্যা ছিল বিচারের বিষয়।অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসকল বিচার থানা পুলিশ এবং আদালত
পর্যন্ত গড়াতো না।কিন্তু বর্তমানে ঐ অবস্থা নেই। সামাজিক বিচার ব্যবস্থার উপর জনসাধারণের আস্থা
নেই।সামন্য কারণে দুই পক্ষে মারামারি হলেও তা থানা পর্যন্ত যায় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী
শত্রুতা সৃষ্টি করে।
সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণ কী?
বাংলাদেশে সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের
বর্তমান রাজনৈতিক সংষ্কৃতি।বর্তমান রাজনৈতিক সংষ্কৃতিতে অধিকতর ভাল এবং সৎ ব্যক্তি
সমাজের নেতা হওয়ার সুযোগ নেই;দেশের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত সমাজ তাই মনে করেন।ফলে বর্তমানে
সমাজের
নেতা একধরণের লাভজনক পদ।পূর্বে এটি পুরোপুরিভাবে একটি অলাভজনক পদ হিসেবেই বিবেচিত হত।
রাজনৈতিক সংষ্কৃতির কারণে জনসাধারণ দুই-তিন ভাগে বিভক্ত। কখনো
তা আওয়ামীলীগ-বিএনপি,কখনো বা স্বাধীনতার
পক্ষ-বিপক্ষ,কখনো বা হিন্দু-মুসলমান
;সমাজের চালাক ব্যক্তিরা সুবিধা অনুযায়ী তা ব্যবহার করেন।সমস্যা সমাধান
বা বিরোধ মিমাংসার লক্ষ্যে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়না।বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়ার
প্রাথমিক পর্যায়েই ঘুষ লেন-দেন হয়। জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলা
হলেতো আর রেহাই নেই।উভয় পক্ষ নির্ধারিত টাকা জামানত রেখে বিচারের মুখোমুখি হন।এইক্ষেত্রে
যেপক্ষ পরাজিত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে তিনি অনুপস্থিত থাকেন।ফলে উপস্থিত বিচারগণ বিচার
প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। ফলে বাদী বা বিবাদী উভয়েই সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়
এবং এক দীর্ঘস্থায়ী ঝামেলার মুখোমুখি হয়।
অন্যদিকে এখন সমাজপতি বলতে বোঝায়
ক্ষমতাসীন দলের নেতা।তারাই সামাজে বিচার করেন।অধিকাংশ চেয়ারম্যান বিচারের ভার তাদের
হাতে ছেড়ে দেন।ফলে আমরা পত্র পত্রিকায় মহিলা শিশু এবং দূর্বলের উপর অত্যাচারের চিত্র
দেখতে পাই।বিচারের মজলিশে অনেক মহিলাকে ন্যাড়া করা হচ্ছে,পিটানো হচ্ছে,শিশুদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা
হচ্ছে।
সামাজিক বিচার ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র:
বাংলাদেশের সামাজিক বিচারের মুখোমুখি যারা হয়েছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে
যেকেহ সহজেই এই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।এইক্ষেত্রে বাদী-বিবাদী কেহই বিচারে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।দিন কয়েক আগে জনৈক ভুক্তভোগীর
সাথে আমার মত বিনিময় হয়েছিল। তিনি পেশায় একজন রিক্সা চালক। তিনি ঘর-ভিটে নিয়ে মামলায় পড়েছিলেন।তারই এক প্রতিবেশি তার কিছু জায়গা জোর পূর্বক
দখলে নিতে ছেয়েছিলেন।তিনি অগত্যা চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দাবি করেন।মামলার শুনানির
তারিখ পড়ে কিন্তু বিবাদী হাজির হন না।সময় অতিক্রম হয়।চেয়ারম্যান সাহেব উপজেলা চেয়ারম্যানের
কাছে যেতে নির্দেশ দেন।বিবাদী শুনানিতে উপস্থিত হন।চেয়ারম্যান সাহেব খুবই ব্যস্ত মানুষ।প্রায়
একবছর শেষ হল।তিনি উভয় পক্ষের জন্য দুইজন উকিল নিয়োগের নির্দেশ দেন।তারা দুই জন জমির
মালিকানা বিষয়ক দলিলাদি পরীক্ষা করে দেখবেন। অত:পর রায় দিবেন।বিবাদী পক্ষের উকিলকে
বিবাদী পক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিলেন।উকিল রিপোর্ট দিতে দুইবার সময় নিলেন। এইদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান রিপোর্ট
দেবার জন্য তাগাদা দেন।অতঃপর উভয় উকিল ঐক্যমতে উপনীত হলেন।বাদী পক্ষ রায়ে জিতলেন। কিন্তু
বিচার প্রক্রিয়ায় অসন্তুষ্ট হলেন।বিবাদী পক্ষও অখুশি হলেন।অযথা অনেকগুলো টাকা নষ্ট
হল।
এর
প্রভাবঃ
সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে আদালতে মামলার পাহাড় জমে উঠেছে।সামাজিক
ঐক্য বিনষ্টি হচ্ছে।মন্দ লোকেরা নেতৃত্বের আসনে বসছে।সরকারি আইনের প্রয়োগে বাঁধা সৃষ্টি
হচ্ছে।
সামাজিক বিচার ব্যবস্থার ভাল দিকঃ
সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় স্বাক্ষী এবং সংগঠিত ঘটনা সামনেই থাকে।ফলে বিচার
প্রক্রিয়ায় মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটানোর সুযোগ থাকেনা।
এখানে বিচারক এবং বিচার প্রার্থী উভয়েই একই সমাজের লোক।
কেহ চাইলেই অন্যকে ফাঁসাতে পারেনা।যখনি এই সকল মামলা থানাপুলিশ আর আদালতে
যায় তখনি বিপত্তির সৃষ্টি হয় এবং বাদী বিবাদী উভয়েই মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির মূখে
পড়েন।
সমাজের নেতাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রচার ও প্রয়োগ সহজতর হয়।বর্তমানে
বাল্যবিয়ে রোধে প্রায়ই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দৌঁড়তে হয়।অথচ এই কাজটি সমাজের
নেতারাই সঠিকভাবে করতে সক্ষম।
সামাজিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপায়ঃ
আগেই বলেছি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিই সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে
পড়ার জন্য দায়ী। তারউপর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় প্রতীকে
করার আইন করেছে।ফলে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যতীত কেউ সমাজে নেতৃত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই।অথচ
সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা যে কোন প্রকার দলীয় পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক। দলীয়
মাস্তান আর অভদ্র লোকের ভীড়ে কোন নির্দলীয় ব্যক্তি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আসবেনা।এই
অবস্থা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রতিবন্ধক।
দ্বিতীয়তঃদুর্নীতিগ্রস্থ ভোট পদ্ধতি যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে আসার পথে
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রচুর অনিয়ম হয়।যার গায়ের জোর বেশি শেষপর্যন্ত সে-ই জয়ী হয়।অতএব নির্বাচন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার
অন্যতম পূর্বশর্ত।
সামাজিক সুবিচার
সমাজের শৃংখলা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।সাথে সাথে সরকারি সিদ্ধান্ত এবং আইনের
প্রয়োগও এদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সহজতর হয়।অতএব সামাজিক বিচার ব্যবস্থা উত্তমভাবে প্রতিষ্ঠা
করায় সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত।
-----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন